‘সামগ্রিক উন্নয়ন’ মানে জানেন তো?
আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক জন সাধারণ কর্মচারীর অত্যন্ত সাধারণ ঘরনি। সন্তানের পড়াশোনা, পরিবারের সকলের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আর প্রতি দিনের অন্নসংস্থান ছাড়া সব কিছুই আমাদের এই স্বল্প আয়ের সংসারে বিলাসিতা। এই সময়, মাননীয় অভিরূপ সরকারের লেখা (‘মহার্ঘ ভাতা বনাম...’, ২১ এপ্রিল, ২০১৬) পড়ে বুঝলাম, পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ-ভাতা আটকে রাখাটা কতটা জরুরি।
অভিরূপ সরকারের বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধা বা প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন করার মতো নির্বোধ আমি নই। তিনি তাঁর আদর্শ রাজনৈতিক চরিত্রের মতো ছলনা না করে প্রায় সরাসরি যে স্বীকার করেছেন যে, কর্মচারীদের ন্যায্য প্রাপ্যকে অবজ্ঞা করার মধ্যেই যে তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর অর্থনৈতিক উৎস, তা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। শ্রীসরকার আইএসআই-এর অধ্যাপক, সরকারে আসীন দলের হয়ে নির্বাচন কমিশনে যান, অর্থ কমিশনের চেয়ারপার্সন, বেতন কমিশনের চেয়ারপার্সন। সেই তিনি কেন যে ক্লাবকে পাঁচ বছরে খয়রাতির টাকা বা মেলা, খেলা, উৎসব, সংবর্ধনার খরচের পরিমাণ এবং গুরুত্বকে ছোট করে দেখাতে গেলেন, তা বুঝলাম না। তিনি তো অর্থের পরিমাণ জানতে সরকারি তথ্য চাইলেই পেতে পারতেন। তবে আরও বড় প্রশ্ন, অর্থের পরিমাণের কম-বেশি দিয়ে কি নৈতিক প্রশ্নের বিচার সম্ভব? তিনি নিজেই মানছেন যে, ন্যায্য পাওনা থেকে কর্মচারীদের বঞ্চিত করছে এ রাজ্য এবং সেই বঞ্চনাতে প্রথম হতে পেরেছে।
অভিরূপবাবু বলেছেন, এই প্রথম একটা সরকার একটা অংশের উন্নয়ন না দেখে সামগ্রিক উন্নয়নের কথা ভেবেছে। জানতে ইচ্ছা করছে, রাজ্য সরকারের ‘সামগ্রিক’-এর মধ্যে কি রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা পড়েন না? আর সামগ্রিক উন্নয়ন? লোহাচোর-খাদানচোর, অভিনেতা-অভিনেত্রী আর একরাশ স্তাবক নিয়ে দেশবিদেশ ভ্রমণে, সামগ্রিকের কোন অংশের কী প্রকার উন্নয়ন হয়, তা বোধ হয় বর্ণনা না করলেও সবাই বোঝে। নামী বেসরকারি কোম্পানিকে সরকারি অর্থ ব্যয় করে সোনার হার সহযোগে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেওয়ার সঙ্গে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের কী সম্পর্ক, তা বোধ হয় অর্থনীতিবিদ ছাড়া বেশি কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বিষমদ খেয়ে মৃতদের পরিবারকে সরকারি অর্থ ব্যয় করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, মোয়াজ্জেন-ভাতা প্রদান, মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের নীল-সাদা রঙে কর ছাড় প্রদান, ক্রীড়া সরঞ্জামের নাম করে বশংবদ ক্লাবকে কোটি-কোটি টাকা অনুদান প্রদান, একই ব্যক্তিকে বছরের বছর বিভিন্ন নামের, আবার কখনও একই নামের পুরস্কার দেওয়া, তথাকথিত উচ্চকোটির বুদ্ধিজীবীদের কমিটি-কমিশনের নাম করে বর্ধিত স্বাচ্ছন্দ্যের সংস্থান— এ সবই কি সামগ্রিক উন্নয়নের খণ্ডিত অংশ?
শ্রীসরকার প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, মহার্ঘ-ভাতার অবণ্টিত অর্থ ‘সামগ্রিক-উন্নয়নে’ কাজে লেগেছে, যদিও রাজ্যের আয়ের উৎস বৃদ্ধি করতে এই ‘সামগ্রিক উন্নয়ন’ কতখানি সফল, তার ব্যাখ্যা যে কোনও কারণেই হোক, তিনি এড়িয়ে গেছেন। যদি ধরে নেওয়া যায়, ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বিতরণ বা কন্যাশ্রী প্রকল্প সাধারণ মানুষের একটা অংশকে উপকৃত করেছে, তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, গত পাঁচ বছরে কোনও প্রকল্প কি রাজ্য সরকার নিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে রাজ্যের রাজস্ব বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে? ২০১১ সালে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকার ৬৪ (১৯৪৭-২০১১) বছরের উত্তরাধিকার সূত্রে ১.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেছিল আর ২০১৬-তে তা ৩ লক্ষ কোটি ছাপিয়ে গেছে। এতই অর্থবহ ‘সামগ্রিক উন্নয়ন’ করেছেন যে ৬৪ বছরে পুঞ্জীকৃত বোঝাকে ছাপিয়ে যেতে চলেছে পাঁচ বছরের বোঝা। এখন না হয় অবণ্টিত মহার্ঘভাতার টাকায় ‘সামগ্রিক উন্নয়ন’ চলল, এর পর কী হবে? সরাসরি বেতনে কোপ? কিন্তু তারও তো শেষ আছে। তার পর? আয়ের উৎস না বাড়িয়ে এক জনের অন্ন ছিনিয়ে নিয়ে অন্যকে দেওয়ার অর্থনীতির যে এক সময় ভরাডুবি হবে, তা বোঝার জন্য কি অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার আছে? এমন হবে না তো যে বর্ধিত স্বাচ্ছন্দ্য ভোগকারী পারিষদ দল নৌকা ডোবার আগে নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে নেবেন, আর দায় ভোগ করবে ৮ কোটি পশ্চিমবঙ্গবাসী।
অভিরূপবাবু মোট রাজস্বের সঙ্গে বেতন খাতে খরচের অনুপাতে কমানোর যে তত্ত্ব পেশ করেছেন, তাতে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু প্রশ্ন, অনুপাত কমানোর একমাত্র পথ কি বেতন কম দেওয়া? রাজস্ব বাড়িয়ে কি তা সম্ভব নয়? সিন্ডিকেট-দীর্ণ রাজ্যে যে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়, তা সবচেয়ে যাঁরা ভাল বোঝেন, তাঁরা যখন এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না রহস্যের সূত্রটি কী।
শ্রীসরকার রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য গঠিত বেতন কমিশনের চেয়ারপার্সন। যে কমিশনের চেয়ারপার্সন বিশ্বাস করেন ‘সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে’ কর্মচারীদের অন্ন ছিনিয়ে নেওয়া জরুরি, সে কমিশন কী সুপারিশ করতে চলেছে, তা বোধ হয় আর ভাবার প্রয়োজন নেই। রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী, স্বশাসিত সংস্থার কর্মচারী এবং সর্বস্তরের পেনশনার ও তাঁদের পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের শুধু বলব— সামনে দিন বড় ভয়ঙ্কর!
মলি সিংহরায়। বেথুয়াডহরি, নদিয়া
॥ ২ ॥
অভিরূপবাবু তাঁর নিবন্ধে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ-ভাতা অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের থেকে কম দেওয়ার পক্ষে অভিনব সওয়াল করেছেন এবং সরকারি কর্মীদের অদক্ষতার নিদর্শন দেখাতে গিয়ে স্কুলশিক্ষার উদাহরণ দিয়েছেন। এক জন শিক্ষক হওয়ায় আমি কতকগুলি বিষয় তুলে ধরতে চাই।
প্রথমত, সরকার শিক্ষা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঠিকমত শিখতে পারছে না, তার কারণ কি শুধুমাত্র শিক্ষকদের অদক্ষতা? বহু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই অনুপাত কখনও ১:৬০ বা ১:৯০ বা ১:১৪০। এমন অবস্থায় প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ভাবে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। অনেক সময় শিক্ষকদের রোজ ৬-৭টা পিরিয়ড নিতে হয়। এরই ফাঁকে ফাঁকে থাকে বিভিন্ন সরকারি পরিকল্পনা, যথা— আয়রন ক্যাপসুল খাওয়ানো, কন্যাশ্রী প্রকল্প, বিভিন্ন অনুদান দেওয়া, মিড-ডে মিল বিতরণ ইত্যাদি প্রকল্প রূপায়ণের কাজ। শিক্ষক যদি অতি-মানবিক ক্ষমতাসম্পন্ন না হন, তা হলে শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য পরিকাঠামো উন্নয়নের দিকটিও নজর দেওয়া প্রয়োজন। অভিরূপবাবু কি এ বিষয়ে অবগত আছেন যে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া ও শৌচাগার পরিষ্কারের জন্য কোনও কর্মচারী সরকার নিয়োগ করে না বা অর্থসাহায্যও করে না? এ ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিদর্শকের মতামত চাইলে তাঁর অফিস থেকে বলা হয় যে, অন্যান্য স্কুল যে ভাবে সাফাই কাজ করে, সে ভাবেই ব্যবস্থা করে নিতে। এ ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার শেখানোর জন্য রাজ্যের সব বিদ্যালয়ে এখনও স্থায়ী-অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি।
চতুর্থত, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিএড ছাড়া আর কোনও ট্রেনিং সরকার থেকে দেওয়া হয় না। তাই বেশির ভাগ শিক্ষকই সাম্প্রতিক শিক্ষাপদ্ধতি, মানোন্নয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ।
পঞ্চমত, শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধি তাঁদের পড়ানোর দক্ষতা, মান বা কর্মকুশলতার মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে না। অর্থাৎ, এক জন দক্ষ আর এক জন অদক্ষ শিক্ষকের ‘ডিগ্রি’ যদি সমান হয়, তবে তাঁরা পাঠ দান করে শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্ট করুন বা না-ই করুন, তাঁদের বেতনবৃদ্ধি সমান হবে। গত পাঁচ বছরে বর্তমান সরকারের আমলেও এ ব্যাপারে কোনও কার্যকর চিন্তাভাবনা করা হয়েছে কি না, তা মাননীয় অভিরূপবাবুই হয়তো ভাল বলতে পারবেন।
সূর্যশেখর হালদার। প্রাক্তন শিক্ষক, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়, নরেন্দ্রপুর
দিনের শেষে ভোট অক্ষত!
২৫ এপ্রিল, ২০১৬। ভোটের পঞ্চম দিন। আমি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। বেশ কয়েক বার ভোট দিয়েছি। বরাবর সকালে লাইনে দাঁড়াতাম। কখনও লাইন বেশ বড়, কখনও একটু ছোট। বেশ রোদেই দাঁড়াতাম। ঘেমেনেয়ে অস্থির হতাম। কিন্তু ওটাই স্বাভাবিক মনে হত। বয়স হওয়ার পর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হত না। তবুও এ বার আমার ছেলের নির্দেশে ভোট দিতে যাব না ঠিক হল, কারণ এ বার আমি অসুস্থ। বিকেল ৫-১৫। চা খাচ্ছি, ছেলে ফোনে বলল, মা, এখন ভোটটা দিয়ে এসো। বাইরে রোদও কমে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। একটা রিকশা ডেকে ৫-৪০ মিনিটে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছলাম। কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জন টহল দিচ্ছেন। ভোটকেন্দ্রের ঘরটা অন্ধকার মতো। ৭-৮ জন কর্মী বসে আছেন। আমাকে দেখে বোধহয় একটু অবাকই হলেন। নির্বিঘ্নে ভোট হল। একটা ব্যাপার দেখে ভাল লাগল, দিনের শেষে আমার ভোটটা অক্ষত রয়েছে। এ তো একটা সভ্য দেশের ভোট। মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। বিগত কয়েক বছরের ভোটে অনেক অশান্তি হয়েছে। এ বার তার পরিবর্তন হল।
অলি বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা-৪৯