‘প্রেক্ষাপট’ (২১-৫) শীর্ষক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগ সম্বন্ধে লেখক লিখেছেন, নাইটহুড ত্যাগের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কারও সঙ্গে পরামর্শ করেননি। আরও লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ সাময়িক উত্তেজনার বশে ত্যাগপত্রটি লিখেছেন এবং পরে এই বিষয়ের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি, জালিয়ানওয়ালা বাগ সম্পর্কে নিরাসক্ত হয়ে পড়েন।
রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা ঘটে যাওয়ার দেড় মাস পর খবর পান। উনি মনে করলেন প্রতিবাদ করা দরকার। তিনি দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ়কে পাঠালেন গাঁধীজির কাছে। প্রস্তাব হল, গাঁধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’ পঞ্জাবে একসঙ্গে প্রবেশ করে আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ জানাবেন। গাঁধীজি বলে দেন, ‘‘আই ডু নট ওয়ান্ট টু এম্বারাস দ্য গভর্নমেন্ট নাউ’’ (আমি এখন এ সরকারকে বিব্রত করতে পারব না)। রবীন্দ্রনাথ এর পর গেলেন চিত্তরঞ্জনের কাছে, প্রতিবাদ সভা ডাকার অনুরোধ করলেন। চিত্তরঞ্জন কবিকে পরামর্শ দিলেন সভা ডাকার জন্য। হতাশ হয়ে কবি গেলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। অনেক আলোচনা হল। তার পর ২৯ মে রাত্রিতে পত্র লিখলেন ভাইসরয়কে— এই পত্র দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ় দেখলেন এবং অনুরোধ করলেন পত্রের ভাষা মোলায়েম করার জন্য। রবীন্দ্রনাথ রাজি হননি। ৩১ মে ১৯১৯ চিঠি পাঠালেন নাইটহুড ত্যাগের।
১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান। সেখানে ইন্ডিয়া অফিসে গিয়ে ভারত সচিব মন্টেগু-র সঙ্গে দেখা করেন, এবং অনুরোধ করেন, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের অন্যায় স্বীকার করার জন্য। ভারত সচিব রাজি হননি। কবি একটি পত্রে লিখলেন, ব্রিটিশ আমলারা ভারতীয়দের ওপর যত দানবীয় অত্যাচার করুক না কেন, ইংল্যান্ডের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে তাতে কোনও লজ্জা বা ক্ষোভ সঞ্চার হয় না।
১৯২০ সালে বোম্বেতে জালিয়ানওয়ালা বাগের প্রথম বার্ষিকী স্মরণ সভায়, রবীন্দ্রনাথ জিন্না সাহেবকে (তখন কংগ্রেস নেতা) দীর্ঘ লিখিত ভাষণ পাঠান। লেখেন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে পঞ্জাবে একটি মহাপাপাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো পাপের এই রকম ভীষণ আকস্মিক প্রকাশ, তাদের পশ্চাতে রেখে যায় আদর্শের ভগ্নস্তূপ ও ভস্মাবশেষের আবর্জনা। চার বছর ধরে যে দানবীয় সংগ্রাম বিধাতার সৃষ্টি এ জগৎকে আগুনে দগ্ধ ও বিষে কলঙ্কিত করেছে, তারই আসুরিক ঔরস্য হল এই জালিয়ানওয়ালা বাগ।
গোপেন্দুভূষণ চৌধুরী
কলকাতা-৭৫
মানা যায় না
‘প্রেক্ষাপট’ (২১-৫) শীর্ষক চিঠির সিদ্ধান্তগুলি মানা যায় না।
১) জাতীয়তাবাদী নেতারা নাকি রবীন্দ্রনাথের নাইট খেতাব গ্রহণকে (১৯১৫) ভাল চোখে দেখেননি।— এ প্রসঙ্গে পত্রলেখক একমাত্র চিত্তরঞ্জনের কথাই বলেছেন। শরৎচন্দ্র এক সময় অমল হোমকে বলেছিলেন, কবির নাইট খেতাব গ্রহণের খবরে দুঃখ পেয়ে চিত্তরঞ্জন কেঁদেছিলেন, এ কথা চিত্তরঞ্জনই শরৎচন্দ্রকে বলেছিলেন। কিন্তু পত্রলেখক যা উল্লেখ করেননি, শরৎচন্দ্র কবির নাইট খেতাব ত্যাগের খবরে দারুণ খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘‘এখন একবার তাঁর (চিত্তরঞ্জনের) দেখা পেলে জিজ্ঞাসা করতাম, আজ আমাদের বুক দশ হাত কি না বলুন’’(‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’, অমল হোম)।
২) লেখকের বক্তব্য, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ নয়, চিত্তরঞ্জন, গাঁধীরাও জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ইংরেজ সরকারকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন। ‘ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে লেখক নেপাল মজুমদার লিখেছেন, ‘‘ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়, রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি বর্জন ও প্রতিবাদপত্র কংগ্রেসী মহলে এতটুকু স্বীকৃতি কিংবা সমাদর পাইল না। এই মহান কার্যের জন্য তাঁহাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়া অমৃতসর কংগ্রেসে কোন প্রস্তাব গৃহীত হইল না।’’ অমল হোম ‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে লিখছেন, অমৃতসরের কংগ্রেস অধিবেশনে (১৯১৯) রবীন্দ্রনাথকে উপাধি বর্জনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লেখা একটি খসড়া প্রস্তাব ‘সাবজেক্টস কমিটি’তে পেশ করার অনুরোধ পাশ কাটিয়ে যান জিতেন বন্দ্যোপাধ্যায়, লালা মনোহরলাল, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন প্রমুখ কংগ্রেসি নেতারা। শেষ পর্যন্ত সৈয়দ হাসান ইমাম অমৃতসর অধিবেশনের সভাপতি মতিলাল নেহরুর কাছে প্রস্তাবটি পেশ করেন। কিন্তু তিনি প্রস্তাবটিকে সযত্নে চেপে দেন। আর গাঁধীজি অন্যত্র বলেন, নাইট খেতাব ত্যাগের জন্য বড়লাটকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিতান্তই 'premature'।
৩) লেখকের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ নাকি সাময়িক উত্তেজনায় নাইট খেতাব বর্জন করেন এবং এর পর তিনি এই বিষয়ে নিজেকে আর জড়াননি। অথচ রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধি হিসেবে অ্যান্ড্রুজ় ১৯১৯-এর অক্টোবর-নভেম্বর পঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে রবীন্দ্রনাথ ও কংগ্রেসি নেতাদের কাছে পঞ্জাবে ইংরেজ সরকারের চরম নির্যাতনের ছবি তুলে ধরেন। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তিতে জিন্নার নেতৃত্বে বোম্বাইয়ে জনসভায় রবীন্দ্রনাথের লিখিত ভাষণ প্রতিবাদের মূল সুরকে বেঁধে দিয়েছিল। ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখার জন্য পঞ্জাবের জেলে বন্দি ‘দ্য ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক কালীনাথ রায়ের কারাবাসের মেয়াদ কমে জেল থেকে মুক্তি ঘটেছিল, কারণ রবীন্দ্রনাথ ভারত সচিব মন্টেগু ও সহ-সচিব লর্ড সিংহকে চিঠি লিখে কালীনাথের মুক্তির জন্য তদবির করেছিলেন (সূত্র: ‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’)।
১৯২০-তে কবি ইংল্যান্ডে পৌঁছে লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া অফিস’-এ গিয়ে মন্টেগু ও লর্ড সিংহের কাছে জানতে চান, অমৃতসরে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার মানবধর্মনীতির বিরোধী, তা ইংল্যান্ড স্বীকার করে কি না। এর পর কবি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারে ও টোরি পার্টির নেতা ভাইকাউন্ট সেসিলের সঙ্গে দেখা করে পঞ্জাবে ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অনুরোধ জানান। পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পৌঁছন। ব্রিটিশ এম্ব্যাসি যে কবির পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছিল, সে কথা লন্ডনের বিখ্যাত ‘নেশন’ পত্রিকা ফাঁস করে দেয়।
পীযূষ রায়
কলকাতা-৩৪
খিলাফত
‘প্রেক্ষাপট’ (২১-৫) পত্রটিতে লেখক ইঙ্গিত করেছেন, ‘খিলাফত কনফারেন্স’-এ সভাপতির পদ থেকে মহাত্মা গাঁধী যখন জাতধর্ম নির্বিশেষে সকলকে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানান, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্বকবির ইউরোপ যাত্রা ঠিক হয়নি। আসলে, গাঁধীজি যে ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে দেশের মুসলমানদের নেওয়ার জন্য জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করেছিলেন, তা রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতে পারেননি। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, এর যৌক্তিকতা ও সার্থকতা সম্বন্ধে অনেকেই ছিলেন সন্দিহান। কারণ, খিলাফতের সঙ্গে ভারতের জাতীয় জীবনের কোনও স্বার্থই জড়িত ছিল না। তা প্রকৃতিতে ছিল ধর্মীয় ‘প্যান ইসলাম’ বা আন্তর্জাতিক মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের হাত ধরে ভারতে মুসলিম জাতীয়তার জন্ম হয়, যা পরে দ্বিজাতিতত্ত্ব রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
গাঁধীজি হয়তো ভেবেছিলেন, একটি সাধারণ স্বার্থের ভেতর দিয়ে দুই সম্প্রদায়কে যদি এক বার ঘনিষ্ঠ করে নেওয়া যায়, তবে উভয় সম্প্রদায়ের ভিতরকার ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভেদগুলি ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে যাবে। সে আশার মধ্যে আগ্রহ এবং সততা যতই থাক, তার ভিতরে পূর্ণ সত্য ছিল না বলে ‘টলস্টয় গান্ধী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক শশিভূষণ দাশগুপ্ত মনে করেন (পৃ ১১৭)। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের পরিণাম, গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয়, ক্রান্তদর্শী কবির মন্তব্য ‘ইট ইজ় ইকুয়াল টু টার্ন মরাল ফোর্স ইনটু আ ব্লাইন্ড ফোর্স’ যথার্থই ছিল।
উজ্জ্বলকুমার মণ্ডল
শেওড়াফুলি, হুগলি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।