বাঙালির বড়দিন উদ্যাপন বেশ বৈচিত্রময়। এক দিকে যেমন এতে থাকে কেক, পাম পুডিং, রোস্টেড চিকেন আর কাবাবের সমারোহ; অন্য দিকে বাঙালি সাহেবদেরও টেক্কা দিয়ে তৃপ্তি করে টার্কি উপভোগ করে। বড়দিনের কেকও হাজির বাঙালির দোরগোড়ায়। এক সময় কালো বাক্স মাথায় নিয়ে মফস্সল থেকে কেক-মিষ্টি-চকলেট হেঁকে ফিরতেন ব্যাপারীরা। বড়দিনকে উপলক্ষ করে নিউ মার্কেটের বেকারি দোকানের কেক, সুগার্ড আমন্ডের স্টক নিঃশেষ করে দেয় বঙ্গসন্তানরা।
এই দিন যে মানুষেরা পার্ক স্ট্রিটের আলো আর অ্যালেন পার্কের আয়োজন দেখতে ঢুকে ভিড়ের মাঝে হারান নিজেকে, তাঁরা তো দুর্গাপুজোয় সুরুচি সঙ্ঘ বা একডালিয়া এভারগ্রিনের ভিড়েও সেলফি স্টিক নিয়ে হাজির ছিলেন। এখানে শুধু লাল-সাদা টুপি পরে সান্টার বংশধর সেজেছেন। পার্ক স্ট্রিট হয়ে ভিড়ে তলিয়ে কখন দিশেহারা হয়ে রেড রোডে পৌঁছে গিয়েছেন, তা মালুমই হয়নি। এই হারিয়ে যাওয়াতেই, আনন্দ-স্রোতে ভাসতেই ধর্মবর্ণখাদ্যনিরপেক্ষ বাঙালি আত্মার পরম তৃপ্তি।
বাঙালি এখন সান্টা ক্লজ় কিনে এনেছে নিজের জন্য, উপহারও দিচ্ছে। ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে বৈঠকখানা ঘর। নিজেও তো সে সান্টা। রাতে মোজায় পেন পেনসিল বা চকলেট পুরে সন্তানের বালিশের নীচে গুঁজে দেয় সান্টারূপী বাঙালি বাবা। এ ভাবেই ক্রিসমাসের আনন্দধারার মূল আনন্দগুলো নিংড়ে এনে জব্বর বড়দিন উদ্যাপন করে জগৎকে তাক লাগিয়ে দেয় বাঙালি। অ্যালেন পার্ক উৎসব না দেখেই ঈশ্বর গুপ্ত সেই কবে লিখে গেছেন, “খ্রিস্টের জন্মদিন, বড়দিন নাম। বহুসুখে পরিপূর্ণ কলিকাতা ধাম।”
এই চরিত্রধর্ম কিন্তু অন্য ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে দুর্লভ। বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি খ্রিস্টান— ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু সবার শোণিতপ্রবাহে বাঙালিত্বের ঔদার্য। তাই খ্রিস্টান না হয়েও আজ গির্জায় কত আমবাঙালি। বিস্তীর্ণ গড়ের মাঠে পঁচিশের ঢল, মিলেনিয়াম পার্ক-সহ গঙ্গার তীরে তীরে হুজুগে বাঙালি পঁচিশে আত্মহারা। দক্ষিণে চিড়িয়াখানা, সায়েন্স সিটি, জলাভূমির পিকনিক ক্ষেত্র থেকে দিঘা, ডায়মন্ড হারবার, ফলতা— সর্বত্র উদ্যাপন। শপিং মলে, কফি শপে, কেকের দোকানে, সিনেমা হলে বড়দিনের ঢেউ। যেন ‘আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান’। দুর্গাপুজোর মতোই তো বছরে এক বার করে জিশুর আগমন, তাই এত রঙ্গ-আয়োজন।
সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৪২
সমন্বয়ের সুখ
বাঙালির জীবনাচরণের মধ্যে সমন্বয়ের এক অসাধারণ মানসিকতা দেখি আমরা। এই মানসিকতার মধ্য দিয়েই বাঙালির গ্রহণ করার ক্ষমতা বেড়েছে। কালক্রমে, সব সংস্কৃতিকেই সে নিজের মতো করে আত্মস্থ করে নিয়েছে। ঠিক এ ভাবেই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি অন্যতম পার্বণ ক্রিসমাস, জিশু খ্রিস্টের জন্মদিন, যা বাঙালির কাছে ‘বড়দিন’। ২৫ ডিসেম্বরের অনেক আগে থেকেই মহানগর কলকাতার বিভিন্ন গির্জা ও সংলগ্ন এলাকাগুলি রঙিন আলো, বেলুন, ক্রিসমাস ট্রি, ঘণ্টায় সেজে ওঠে। পার্ক স্ট্রিট, অ্যালেন পার্ক, বো ব্যারাকস, ধর্মতলা চত্বর আলোকমালায় সাজিয়ে জিশুর আবির্ভাবকে স্বাগত জানানো হয়। এমনিতেই এ সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মিলেনিয়াম পার্ক, ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়ম, বটানিক্যাল গার্ডেন, বিড়লা তারামণ্ডল ও বিভিন্ন পার্কে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। বড়দিনে শহরের সব চার্চই বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। মাথায় লাল টুপি পরা মানুষের ভিড়, তাদের মাঝে সান্টা ক্লজ়ের উপস্থিতি ভিন্ন মাত্রা আনে।
সাহেব পাড়ার অলিগলিতে শীতের বিকেলে নরম ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে ঘুরতে ঘুরতে বাড়িগুলোর অপরূপ স্থাপত্যের দিকে নজর পড়লেই নস্টালজিয়া-কাতর হয়ে ওঠে মন। ইডেনের সবুজ মাঠে শীতকালে টেস্ট ক্রিকেটের ধারাবিবরণী রেডিয়োতে শুনে যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁদের স্মৃতিতে আজও অমলিন অজয় বসুর ধারাভাষ্য— “ক্রিকেটের নন্দনকানন, ইডেন উদ্যান থেকে কথা বলছি” কিংবা “সবুজ ঘাসের বুক চিরে লাল বলটি সীমানার বাইরে, চার-চারটি রান।” খেলার মাঠে না থেকেও মাঠের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠত। শীত এলে এই সব সুখস্মৃতি মনে পড়ে। রিলের যুগে সেই কল্পনার জগৎ আজ যেন হারিয়ে গিয়েছে।
এই সময় শহর জুড়ে চলে উৎসবের কার্নিভাল, প্রকৃতই ‘সিটি অব জয়’-এ পরিণত হয়। নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, নাট্যোৎসব, কলকাতার বহু জায়গায় সার্কাসের শো, পিঠে-পুলি উৎসব, মিলন মেলা সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। শহরের দোকানগুলি ভরে ওঠে কেক, জয়নগরের মোয়া, নলেন গুড়ের গন্ধে। কেকের দোকানের সামনে ক্রেতাদের লম্বা লাইন। ‘ক্রিসমাস ইভ’ রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখা কেন্দ্রেও পালিত হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে এই দিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর এই সন্ধ্যায় জিশুর জীবনের আদর্শের কথা স্মরণ করে স্বামীজি ও তাঁর কয়েক জন গুরুভ্রাতা ত্যাগ ও সেবাব্রতে নিজেদের জীবন উৎসর্গের শপথ নেন। তাই, সন্ধ্যায় এই দিনে প্রার্থনা, ক্যারল, বাইবেল পড়া, জিশুর জীবনী আলোচনা হয়। কেক, পেস্ট্রি, চকলেট সহযোগে জিশুকে ভোগ নিবেদন করা হয়।
শীতকাল, ক্রিসমাস বয়ে আনে আনন্দ, উৎসবের পেলব ছোঁয়া। বাঙালি বেরিয়ে পড়ে খোশমেজাজে পিকনিক জমাতে মাঠ, পার্ক কিংবা নদীর তীরে। গ্ৰামবাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় পৌষপার্বণ এবং নবান্ন— সোনার ফসল ঘরে তোলার পালা। এখনও শীতকালে গ্ৰামে-গঞ্জে যাত্রাপালা, মাঙ্গলিক গান, কীর্তনের আসর, কবিগান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বেশ উৎসাহ, উদ্দীপনার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। শিলিগুড়ি থেকে শান্তিনিকেতন সর্বত্রই এ সময় পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ে। পর্যটন এবং বিভিন্ন কুটির শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে আর্থিক রোজগারের আশায়। তীব্র শীতের কষ্টেও তাঁদের ঘর আনন্দ নিকেতনে পরিণত হয়। শহর থেকে গ্ৰামে বড়দিন এবং বিভিন্ন সামাজিক উৎসব, পার্বণকে কেন্দ্র করে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে নানা ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বাঙালির এক চিরন্তন সাংস্কৃতিক সমন্বয় রচিত হতে দেখি আমরা।
অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩
পিঠের স্বাদ
পৌষ ও পিঠেপুলি একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পিঠের নানান ধরন, তেমনই নানা গড়ন, রন্ধন পদ্ধতি ও স্বাদ। কত নামে বিরাজমান সেই সব পিঠে, যার মূল উপাদান চাল ও চালের গুঁড়ো। এক সময় প্রতি ঘরে পালিত হত পিঠে উৎসব। বর্তমানে তাতে এসেছে বদল। বহু ক্ষেত্রেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে তা হয়ে উঠেছে নিয়মরক্ষার। আসলে পিঠে তৈরির প্রস্তুতি থেকে সমগ্ৰ পদ্ধতিটাই ধৈর্য, পরিশ্রম ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। চাল গুঁড়ানো থেকে খাবার প্লেট পর্যন্ত পৌঁছতে অনেক পদ্ধতি অতিক্রম করতে হয়, পিঠে ভেদে পদ্ধতিও ভিন্ন। হরেক সে সব নাম, যেমন আছে আস্কে, পুলি, সরু চাকলি, ভাজা, ভাপা ইত্যাদি, তেমনই দুধে সেদ্ধ দুধপুলি। তাই পৌষ এলেই মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। মা জেঠিমা কাকিমাদের পিঠে নিয়ে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল। বেশ কয়েক দিন চলে যেত ভেজানো নতুন ধানের চাল হালকা শুকিয়ে নিয়ে শিলে গুঁড়ো করতে। ভেজা চালে শিল নোড়ার ঘর্ষণে বিশেষ শব্দ উঠত। পাশে সাদা চাল গুঁড়ির স্তূপ।
পিঠের সে দিন আজ প্রায় অতীত, গম ভাঙানো মেশিনে কেউ কেউ চাল গুঁড়িয়ে নেন। নয়তো বাজারে পাওয়া যায় প্যাকেটজাত চালের গুঁড়ো। তাই দিয়েই সারা পিঠে-পুলি উৎসব। এ ছাড়া বিভিন্ন মেলায় গেলে পাওয়া যেতে পারে নানা ধরনের পিঠে। বাঙালির রসনা তৃপ্ত হয় সেখানেও।
সনৎ ঘোষ, বাগনান, হাওড়া
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে