আজ যে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে সারা পৃথিবী তোলপাড় হচ্ছে, এই ভাইরাস কিন্তু নতুন কেউ নয়। বরং অনেক দেশেরই সাধারণ মানুষের লালারসে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়। কিন্তু আজকের ভাইরাসটির বিশেষত্ব হল যে এটি নভেল, মানে মানবজাতির শরীর এইটিকে চেনে না। তা হলে এ এল কোথা থেকে? এখনও সঠিক জানা যায়নি, তবে অনুমান করা যায়। অনেক প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে এই ভাইরাস থাকে, তাদের কিছু হয় না, তাদের সঙ্গেই থাকে। অনেক সময় এই করোনাভাইরাসগুলোয় প্রাকৃতিক নিয়মে এমন কিছু পরিবর্তন আসে যে এরা বাদুড় থেকে মানুষ বা অন্য স্তন্যপায়ী জন্তুদের ভেতর চলে আসতে পারে। এই ঘটনাটিকে বলে মিউটেশন, এবং এটি ‘র্যান্ডম ইভেন্ট’। এই স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলি কখনও মানুষের সাহচর্যে থাকে, যা চিনদেশের এই প্রাণীদের বাজারগুলোতে খুব বেশি মাত্রায় হয়। যদি এই মিউটেশনের সময় মানুষ সাহচর্যে থাকে, তবে এই ভাইরাস চট করে ঢুকে যেতে পারে মানবশরীরে, আর সেখানে এ একেবারেই নতুন। তার কয়েকটি শক্তি থাকলেই সে জন্ম দিতে পারে মহামারি বা অতিমারির। মানুষের শরীরের কোনও ধারণাই থাকে না একে নিয়ে কী করবে, আর সে ছড়িয়ে পড়তে পারে দূরদূরান্তে, মানবসভ্যতার অসাধারণ জনসংযোগের হাত ধরে।
হয়তো অনেকেই জানেন না, ২০০২ সালের যে সার্স মহামারিটি হয়েছিল, সেটিও ছিল করোনাভাইরাসের। তবে অন্য প্রজাতির। একই ভাবে চিনে জন্তু-জানোয়ারদের খোলা বাজার থেকে সেটি আর একটি প্রাণীর মধ্যে আসে এবং তার পর ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। আবার ২০১২ সালে হয়েছিল মার্স (MERS—Middle Eastern Respiratory Syndrome), তাও করোনাভাইরাস থেকে। সার্সেরও অতিমারি হওয়ার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু কিছু দিন কয়েকটি দেশে ৭৭৪ মৃত্যু ঘটিয়ে বেমালুম উবে গেল পৃথিবীর বুক থেকে। প্রশ্ন, সার্স হঠাৎ চলে গেল, কোভিড-১৯ যাচ্ছে না কেন, দুটি তো প্রায় তো সমানই। উত্তরটা লুকিয়ে আছে এদের প্রকৃতিতে।
প্রথমত বলতে হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ডের কথা। জীবাণু ঢোকার ক’দিন পর থেকে শরীরে উপসর্গ দেখা যাবে, সেটাই ইনকিউবেশন পিরিয়ড। তার মানে যদি এটি কম হয়, তবে রোগী তাড়াতাড়ি উপসর্গ নিয়ে আসবে আর অসুখের কারণে তাড়াতাড়ি বাড়িতে বসে যাবে, মানে ছড়াতে পারবে কম। সার্সের এই সময়ের গড় ছিল ৭ দিন, আর কোভিডের ১৪ দিন। মানে কোভিড রুগির সংক্রমণ হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন উপসর্গ নেই, মানে ধরা পড়ছে না, আর এতটা অসুস্থ হয়ে পড়ছে না, যে বাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে চলাফেরা না করে। আর এই সময়টায় সে জীবাণু ছড়াচ্ছে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়টাতেই তার সংক্রমণ ঘটানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আবার এ রকমও রোগী পাওয়া গেছে, যাদের কোনও উপসর্গই নেই, কিন্তু তারা রোগ ছড়াতে সক্ষম, এরা asymptomatic carrier। আর ঠিক এই কারণেই কোভিড নিজেকে ছড়াতে অনেক বেশি সক্ষম।
আর একটি কারণ হল মৃত্যুহার। সার্সের মৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল, প্রায় ১০ শতাংশ, করোনার তার চেয়ে অনেকটাই কম। ভাইরাসটি যে রুগিদের ধরছে, তাদের অনেকেরই যদি মৃত্যু হয়, তবে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায় স্বাভাবিক ভাবে।
লকডাউন করে এই ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে না। এই ভাইরাসের সার্সের মত দুম করে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং আস্তে আস্তে অনেক মানুষকে সংক্রমিত করবে, তৈরি করবে 'herd immunity', যাতে বেশির ভাগ মানুষ প্রতিরোধ-ক্ষমতা পেয়ে যাবে। অন্তত ৫০-৬০% মানুষের সংক্রমণ হলে এই হার্ড ইমিউনিটি চলে আসবে। তাই লকডাউন করার উদ্দেশ্য এই ভাইরাস নির্মূল করা নয়, বরং সংক্রমণের হারটাকে কমানো। প্রায় ৮৫% মানুষের কোনও চিকিৎসা লাগবে না সারতে। কিন্তু ১০-১৫% গুরুতর অসুস্থ হবেন, চিকিৎসা লাগবে। তাই যাতে এক সঙ্গে হঠাৎ প্রচুর গুরুতর অসুস্থ মানুষ না চলে আসেন হাসপাতালে, সংক্রমণের হারটা কমানো জরুরি।
তবে এই মহামারির ভবিষ্যৎ কি? আস্তে আস্তে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, হয়তো বা টিকাও তৈরি হয়ে যাবে। বছর বছর এই ঋতুতে আসবে, আসতেই থাকবে, তবে এতটা সাংঘাতিক ভাবে নয়, অবশেষে অন্য অনেক সহজীবী জীবাণুর মতো থেকে যাবে মানুষের সঙ্গে।
ঋভু বসু
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা
দূরত্ব, ভালবাসা
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দেশ জুড়ে লকডাউন। এই আবহে মানুষ যতটা সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন, ঠিক ততটাই পরিবার-ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। স্বজন পরিজনদের সঙ্গে আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর অফুরন্ত সময় পেয়েছে। মনোবিদরা জানাচ্ছেন, এই হঠাৎ পাওয়া ঘন্টাগুলো একে অপরের মধ্যে হওয়া ‘দূরত্ব’ কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ‘কাজে লাগানো’ উচিত। আমরাও হাসি-হাসি মুখ, সুখী-সুখী মন নিয়ে ভাবছি, এই তো সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালি মুহূর্তেরা কড়া নাড়ছে মনদুয়ারে। কিন্তু পুরো বিষয়টাকে এমন ভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, যেন দৈনন্দিন কাজের চাপে একে অপরের থেকে দূরে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সন্তানকে সময় দিতে না পারাটাই যেন স্বাভাবিক। স্বামী- স্ত্রী’র সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাটাই স্বাভাবিক। আর এই লকডাউনে সেটা কিছুটা কমিয়ে ফেলাই যায়। আর তার পর? যখন সব ঠিক হয়ে যাবে? আবার দৈনন্দিন অফিস যাপন শুরু হবে? তখন আবার দূরত্বটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে? প্রকৃত ভালবাসায় তো দূরত্ব তৈরিই হওয়া উচিত নয়। আর এটাও মনে রাখা উচিত, এই ‘কোয়ালিটি টাইম উইথ ফ্যামিলি’ কেউ স্বেচ্ছায় পায়ওনি। বাধ্য হচ্ছে থাকতে। যদি এমন দুর্দিন না আসত? মনের দূরত্ব কমতই না তা হলে? পনেরো বা তিরিশ দিনে দূরত্ব কমিয়ে কী লাভ, যদি দৈনন্দিন জীবনে ‘কাজের চাপে’ দূরত্ব বেড়ে যাওয়াটা একটা সমাজের কাছে নিতান্ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে?
অগ্নি মুখোপাধ্যায়
পার্বতীপুর, হাওড়া
কৃতজ্ঞ
আশি বছর বয়সে এসে, ডাক্তার-আত্মীয়-পাড়াপড়শি সবার কাছে যখন শুনতে হচ্ছে ‘আর কত, বয়স তো হল’, তখন হঠাৎ হাওয়ার মত দূরভাষে খবর এল, করোনা-আক্রান্ত এই বাংলায় আমি এখনও বাতিল হয়ে যাইনি। ডাক ও তার বিভাগের কর্মী ছিলাম, এখন পেনশনভোগী। ৩ এপ্রিল বিকেলে বেলেঘাটা পোস্ট অফিস থেকে সনির্বন্ধ অনুরোধ এল, পেনশন নিতে নিকটবর্তী ডাকঘরে সশরীরে যেন না যাই, পরিবারের কাউকে পাঠালেই হবে। চমকে ওঠার আরও বাকি ছিল, যখন প্রধান ডাকঘর থেকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে জানানো হল, বরিষ্ঠ নাগরিক বলে, আমি চাইলে ডাকঘর কর্তৃপক্ষ আমার বাসস্থানে এসে পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
আশুতোষ দত্ত
কলকাতা-১০২
অনেকের নেই
লকডাউনের সময় অনলাইন বা জুম, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বন্দোবস্ত অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। তবে এটিও খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের রাজ্যের অনেকের কাছে মোবাইল ফোন বা টিভি থাকলেও, অনেকেরই এখন এত টাকা খরচ করে রিচার্জ করার মতো সামর্থ্য নেই। আবার সকলের কাছে ক্লাস করার উপযোগী স্মার্টফোনও নেই। তাই রাজ্যের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই বর্তমানে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেটা মাথায় রেখেই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাশ এই কথা ভেবেই আর্টস বিভাগের অনলাইন ক্লাস বন্ধ রাখার কথা বলেছেন।
নাজিবুর রহমান মল্লিক
হেলান, হুগলি