দীর্ঘ, অব্যক্ত এক যন্ত্রণা বহন-করা মনের উপর কপিল কমিরেড্ডির নিবন্ধ (‘আপনি যা করতে পারেন’, ২৬-২) যেন এক আরামের প্রলেপ। আশঙ্কা হয়, রাহুল গাঁধীর দৃশ্যত বিশ্বস্ত বাহিনী কি আদৌ তাঁর প্রতি, দলের প্রতি বা দেশের প্রতি দায়বদ্ধ? না কি প্রতিপক্ষের নির্দেশ অনুসরণ করছে? নইলে দেশব্যাপী বিরোধী ঐক্য ভিন্ন যে এই অচলায়তন ভাঙা যাবে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে না কেন? সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার সামান্যতম তাগিদ কি তিনি বা তাঁর অনুরাগীরা অনুভব করেন? বরং, এর বিপরীত কার্যক্রমেই বেশি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
লেখকের সঙ্গে অনেক বিষয়ে সহমত হয়েও একটু ভিন্ন মত পোষণ করি। কংগ্রেস দলে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়েও এখন জরুরি, এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া। এটা কি দলের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উপযুক্ত সময়? দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও কোনও বড় লক্ষ্য সামনে রেখে দলকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ গাঁধী পরিবার ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব নয়। ফলে, রাহুল, প্রিয়ঙ্কা বা সনিয়া, যিনিই হোন, তাঁর নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি, বা খানিকটা বড় কর্মসমিতিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা দরকার। সবার মত ব্যক্ত করার সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গেলে সঙ্কট কাটতে পারে।
কিছু দিন আগেই কংগ্রেসের ২৩ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা একটি চিঠিতে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে। সেগুলিও যথেষ্ট ভাল ও আলোচনার দাবি রাখে। সমস্যা, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে। সার্বিক বিরোধী ঐক্যের জন্য সচেষ্ট হওয়ার এটাই সময়। আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত ন্যূনতম কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের ‘রোডম্যাপ’ স্থির করে নেমে পড়তে হবে রাস্তায়। এই কাজটা ইতিমধ্যেই দেশের কৃষকসমাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা একটা বড় ধাক্কা দেওয়ার।
নিপাট সর্দার, কলকাতা-৫৪
অরণ্যে রোদন
কংগ্রেস দল থেকে মোসাহেবদের বিতাড়নের যে সুপরামর্শ রাহুল গাঁধীকে দিয়েছেন কপিল কমিরেড্ডি, তা তো অরণ্যে রোদন। উত্তরাধিকার সূত্রে যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব পান, তাঁরা সর্বদা মোসাহেব পরিবৃত হয়ে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। যেখানে সর্বদা তাঁর গুণকীর্তন হবে, তাঁর নেতৃত্বের ব্যর্থতা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। গাঁধী পরিবার অত্যন্ত সচেতন ভাবে অনুগত বাহিনী তৈরি করে থাকে। এটাই তাদের রাজনৈতিক দর্শনের প্রথম পাঠ, তথা চর্চা। নইলে, রাজনীতির অঙ্গনে পরিবারের সদস্যদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র বিপন্নই হবে না, বিলুপ্তিও ঘটবে।
প্রশ্ন জাগে, রাহুল গাঁধী কি কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় দলের প্রধান নেতা হওয়ার যোগ্য? তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, রাজনীতির জন্য শ্রম, আন্তরিকতা, শর্তহীন শ্রদ্ধা ও দায়িত্বপরায়ণতা— সব কিছুর নিরিখে তা বিচার করা চাই। একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের প্রধান হলে রাজনীতির প্রতি যে ভালবাসা ও আগ্রহ থাকা জরুরি, রাহুল গাঁধীর মধ্যে তা আছে কি? একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম কর্মসূচি হল, তার প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা, এবং ওই দিন জনসংযোগের মাধ্যমে দলের সদস্য, কর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভবিষ্যতের কর্মসূচি ও রাজনৈতিক আদর্শকে তুলে ধরা। এ বারের কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবসে রাহুল গাঁধীকে পাওয়া যায়নি। তিনি বিদেশে ছুটি কাটাতে ব্যস্ত ছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রতি, নিজ দলের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার এর চেয়ে ভাল ‘নিদর্শন’ আর কী-ই বা হতে পারে!
মনে হয়, রাহুল এবং তাঁর বোনের রাজনৈতিক লক্ষ্য শুধুমাত্র তিনটি লোকসভা কেন্দ্রকে ঘিরে। প্রিয়ঙ্কা গাঁধী তো পাঁচ বছর অন্তর এক বার ঘর থেকে বার হন, মা ও দাদার লোকসভা আসনটিকে সুরক্ষিত রাখতে। মানুষের প্রতি ভালবাসা গাঁধী পরিবারের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে আর নেই। শুধুমাত্র নিজেদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কুক্ষিগত করে রাখাই তাঁদের লক্ষ্য। তারই জেরে কংগ্রেসে নতুন নেতৃত্বের উত্থান অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ। মোসাহেবদের গণ্ডির বাইরে পা রাখার ইচ্ছা বা প্রয়োজন গাঁধী পরিবারের নেই। তাতে সারা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং কংগ্রেস দলের যত ক্ষতিই হোক না কেন, তাঁদের কী-ই বা যায় আসে? আর সেই কারণেই নিজের লোকসভার প্রবেশপত্র জোগাড় করতে স্বয়ং রাহুল গাঁধীকে নিজের জায়গা উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে বামেদের হাত ধরে কেরলের আশ্রয় নিতে হয়! বর্তমান শাসক দলের কুশাসনে সারা দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, ধর্মীয় উন্মত্ততা বিরাজ করছে, যার আঘাত এসে পড়ছে গণতন্ত্রের উপর। এর বিরুদ্ধে লড়াই ভীষণ কঠিন। প্রয়োজন, পরিকল্পিত পরিকল্পনার সঙ্গে সদর্থক নেতৃত্ব। রাহুল গাঁধী কি এত বড় লড়াইয়ে নেতৃত্ব দানের মতো রাজনৈতিক ব্যুৎপত্তির অধিকারী?
কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে প্রায় সারা দেশে শাসক দল বিরোধী যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দিতে পারলে সরকার, তথা শাসক দল আরও পর্যুদস্ত হত, যা একই সঙ্গে গণতন্ত্রের বিপন্নতাও কমাত। এ বিষয়ে কংগ্রেস, তথা রাহুল গাঁধীর বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি তা কতটা পালন করেছেন?
রাহুল গাঁধীর কাছে ভারতীয় গণতন্ত্রকে বাঁচানোর আবেদন করা নিষ্ফল ক্রন্দন। বরং, গণতন্ত্রের এই বিপন্নতায় কংগ্রেস দলের অন্যান্য সদস্য, নেতাদের প্রথমেই কংগ্রেসে গাঁধী পরিবারের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করা দরকার, যাতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
কংগ্রেসই পারে
কপিল কমিরেড্ডির প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, এনডিএ সরকার যে ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর আঘাত হানছে, তাকে মোকাবিলা করার জন্য এক উপযুক্ত বিরোধী দল আবশ্যক। সর্বভারতীয় দল হিসেবে একমাত্র কংগ্রেসই পারে সেই ভূমিকা নিতে। সেটা না হলে কী হতে পারে, তার জন্য রাশিয়া এবং তুরস্কের দিকে তাকালেই হবে। রাশিয়ায় পুতিনের একনায়কতন্ত্রের ফলে নাভালনি-নির্যাতন এবং তার ফলে গণবিক্ষোভ ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্কের ধর্ম-নিরপেক্ষ চরিত্র বিপন্ন হতে চলেছে। উপযুক্ত বিরোধী হিসেবে ডেমোক্র্যাট দল না থাকলে আমেরিকা কি ‘ট্রাম্প’ নামক অভিশাপটির হাত থেকে কোনও দিন মুক্তি পেত?
নরেন্দ্র মোদীর শাসন কালে ভারতের সার্বিক চেহারা কী ভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, তা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রবিরোধিতা আইনে যেখানে ২০১০-১৪ সময়কালে ৩৭৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেখানে ২০১৪-২০২০ সময়কালে ৭১৩৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার সংখ্যা ২৭৯ থেকে ৫১৯ হয়েছে এবং বার্ষিক গড় মামলার সংখ্যা ৬২ থেকে বেড়ে ৭৯.৮ হয়েছে। কর্মহীনতা-সংক্রান্ত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৭-১৮ বছরের রিপোর্টে দেখা যায়, ওই বছরে কর্মহীনতার হার বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ (৬.১%) হয়েছে। ২০১০-২০১৪, এই সময়কালে গণপ্রহারে হত্যার মোট সংখ্যা ছিল ২৪, সেখানে ২০১৯ সালেই ২৩টি ঘটনা ঘটেছে। কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২০১৪ সালে ৫৬৫৬ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে ৫৯৫৭ হয়েছে। ভারতের ধর্ম-নিরপেক্ষতার উপর আঘাত হেনে মুসলিম-বিরোধী সিএএ আইন আনা হয়েছে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউপিএ-শাসিত সরকারও দেশে সুশাসন কায়েম করতে পারেনি। কারণ, প্রধান শরিক হলেও কংগ্রেস দল দিশাহীন ছিল এবং কংগ্রেস-সভাপতির অনুগত ব্যক্তি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ছিলেন খুবই দুর্বল। তাই কংগ্রেসকে অভ্যন্তরীণ ত্রুটিমুক্ত হয়ে এক স্বচ্ছ ও শক্তিশালী বিরোধী দলে পরিণত হতে হবে। সেখানে পরিবারতন্ত্রকে দেশের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে হবে।
পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা