Society

সম্পাদক সমীপেষু: সমস্যার শিকড়

শিক্ষা দফতর থেকে ঢালাও নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়াটাই যখন স্বীকৃত রীতি, তখন এ প্রশ্নের উত্তর কি সহজ?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:৫৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

দুঃস্থ-মেধাবী পড়ুয়াদের সাহায্যার্থে একটি সংগঠনে যুক্ত থেকে কিছু স্কুলের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সামান্য অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তার সঙ্গে কুমার রাণার ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ (৯-১০) প্রবন্ধের সাযুজ্য অনেকটাই। প্রবন্ধকার যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষার দায় কি কেবল শিক্ষকের, না কি সমাজেরও? উত্তরটা সহজ এবং কঠিন। প্রথমত, ছাত্রছাত্রীরা পাঁচ বছর বা আট বছর স্কুলে কাটানোর পরও তাদের শিক্ষাগত মান অর্জনে ঘাটতি থাকছে, এই সহজ সত্যটা প্রমাণ করা বেশ কঠিন। এখন তেমন কিছু না-জানা ছাত্রছাত্রীও ৫০-৬০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করে যাচ্ছে। বাংলায় (বা ইংরেজিতে) লেটার মার্কস পাওয়া কিছু পড়ুয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে, তাদের ভাষা বা বানান সম্পর্কে বিশেষ ধারণাই হয়নি। ওরা বানান শিখবেই বা কেমন করে! স্কুলের কিছু প্রশ্নপত্রে চোখ রেখেই (‘কি’, ‘কী’ ইত্যাদি) বোঝা গেছে সমস্যাটা কোথায়। শিক্ষা দফতর থেকে ঢালাও নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়াটাই যখন স্বীকৃত রীতি, তখন এ প্রশ্নের উত্তর কি সহজ?

Advertisement

দ্বিতীয়ত, স্কুলগুলোকে নিজেদের মতো পরিকল্পনা করে চলতে দেওয়ার স্বাধীনতার প্রস্তাব যে নিরর্থক, তার বড় প্রমাণ— সমস্ত সরকার-পোষিত স্কুলেই পরিচালন সমিতিতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা সরকার, তথা শাসক দলের প্রতিনিধিদেরই। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব পরিকল্পনার পথে স্কুল চলবে, এমন আশা সত্যিই অর্থহীন। তৃতীয়ত, বছরের ক’দিন স্কুল খোলা থাকছে, স্কুলে প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষক আছেন কি না, থাকলেও পড়ুয়াদের শিক্ষাদানের উপযুক্ত শিক্ষক কত জন (নিয়োগ দুর্নীতি এ প্রশ্ন তুলেছে), এবং বছরে অন্তত কত দিন স্কুল খোলা থাকার কথা, সে-সব নিয়ে আদৌ প্রশ্ন তোলার অধিকার সমাজের আছে কি? আর থাকলেও, সরকার তথা শিক্ষা দফতর জনতার এ-হেন অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দিতে যে বাধ্য নয়, তার প্রমাণ অতীতেও আমরা পেয়েছি, এবং বর্তমানেও পেয়ে চলেছি।

সর্বোপরি, প্রবন্ধকারের মূল প্রশ্ন হল, শিক্ষার সংস্কার আগে, না শিক্ষা আগে? এ-প্রশ্নের একটাই উত্তর হওয়া উচিত, শিক্ষার সংস্কার আগে। বলা বাহুল্য, শিক্ষার সংস্কার কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধিদের প্রভাব থাকলে হবে না; শিক্ষাবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই কমিটি তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবেই স্কুলের পরিকাঠামো থেকে শুরু করে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি কেমন হবে, সেই সত্য উঠে আসা সম্ভব। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘আমরা ফার্স্ট’, আর স্কুলশিক্ষকদের দ্বারা প্রাইভেট টিউশনের ব্যাপারেও আমরাই সর্বাপেক্ষা এগিয়ে— শিক্ষাঙ্গনে এই চরম অব্যবস্থা জারি রেখে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বাস্তবিকই কঠিন।

Advertisement

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

আগে সংস্কার

কুমার রাণা প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার সংস্কার আগে, না শিক্ষা আগে? শিক্ষার দায় কি কেবল শিক্ষকের, না সমাজেরও? আরও প্রশ্ন করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের বেশি কেন বিদ্যালয়ে আসে না? প্রাইভেট টিউটরের উপর ছাত্রছাত্রীরা কেন বেশি নির্ভরশীল? শিক্ষা দফতরের দায়বদ্ধতার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন।

একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চাই। অতিমারি এবং তার পরবর্তী কালে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি রাজ্যের সব সরকারি এবং সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে— ৫০ জনের কম ছাত্রছাত্রী আছে, এই রকম ৮২০৭টি বিদ্যালয়কে সরকার চিহ্নিত করেছে। অতিমারির পর থেকেই ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার পরিমাণ তারা কমিয়ে দিয়েছে হয় অর্থ উপার্জনের জন্য, নাহয় ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ, তার পঠনপাঠন পদ্ধতি, অত্যাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, জীবন গঠনের বিভিন্ন উপাদান এবং সর্বোপরি সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ— যদি এ সব পায়, তা হলেই তারা আনন্দে বিদ্যালয়ে প্রত্যেক দিন উপস্থিত হবে।

কিন্তু তার বদলে বিদ্যালয়গুলি থেকে তারা কী পাচ্ছে? পাচ্ছে অপরিষ্কার পরিবেশ, দুর্গন্ধময় শৌচাগার, নোংরা ক্লাসরুম, (কারণ, অনেক বিদ্যালয়েই ঝাড়ুদার নেই), রংচটা, পলেস্তারা খসে-পড়া দেওয়াল, নড়বড়ে চেয়ার-টেবিল, মাথার উপর না-ঘোরা ফ্যান ইত্যাদি। এর পর ক্লাস শুরুর পর থেকেই অঙ্ক পিরিয়ডে ইংরেজি স্যর বা বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন ভূগোলের স্যর। তা ছাড়া তিন-চারটি করে পিরিয়ড অফ যাচ্ছে, কারণ উৎসশ্রীতে যে সব স্যর বা ম্যাডাম বদলি নিয়ে চলে গিয়েছেন, সেই সব পোস্ট বছরের পর বছর ফাঁকা পড়ে আছে। এমনও উদাহরণ আছে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে প্রায় হাজারখানেক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সেখানে মাত্র ১০-১২ জন। আবার এক-একটি শ্রেণিতে, যেখানে ৩৫ জন করে ছাত্রছাত্রী থাকার কথা, সেখানে ৮০-৮৫ জন করে ছাত্রছাত্রী গাদাগাদি হয়ে বসে ক্লাস করছে। আর কম্পিউটার শিক্ষা, স্মার্ট ক্লাসরুম বা শারীরশিক্ষার জন্য জিম, এ সব তো স্বপ্নমাত্র।

আর সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ? এইট পাশ-করা ছেলেটি যখন বলে, “স্যর পড়ে কী হবে? বাড়িতে আমার দাদা, দিদি এমএ, বিএড পাশ করে বসে আছে। কোনও কাজ পায়নি। সেই জন্য বাবা বলেছে, তুই এইট পাশ করলেই তোকে মুম্বই বা দিল্লিতে হাতের কাজে পাঠিয়ে দেব।” আর কি সেই ছেলেটির পড়ার আগ্রহ থাকে? আবার সে জানে, এইট পর্যন্ত যদি বিদ্যালয়ে না-ও আসে, বা সব পরীক্ষা না-ও দেয়, অথবা সব পরীক্ষাতেই যদি শূন্য পায়, তা হলেও সে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। তা হলে সে পড়বে কেন? আর বিদ্যালয়ে আসবেই বা কেন? বর্তমানে আনন্দের সঙ্গে পাঠদান, বা ভয়হীন শিক্ষাদান করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা জানে, পড়াশোনা না করলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাদের বকাঝকা বা গায়ে হাত দিতে পারবে না। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা এখন বেপরোয়া।

আর শিক্ষা দফতর? জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিল সার্কুলার জারি করেই ক্ষান্ত। সেই সার্কুলার ঠিকঠাক প্রয়োগ হল কি না, বা যে সব বিদ্যালয় তা মানল না, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা করা হল কি না, তা কি দেখা হয়? বিদ্যালয় পরিদর্শন করে সুবিধা ও অসুবিধার কথা শোনাও হয় না। এমনকি বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গেলেও সময়মতো তদন্ত করার অবকাশ নেই। বর্তমানে বিদ্যালয়গুলি কোনও রকমে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে কিছু শিক্ষাদরদি শিক্ষক-শিক্ষিকার জন্য। তাই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিকে ব্যতিক্রমী করে তুলতে গেলে, আগে বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, শিক্ষানীতি, শিক্ষা দফতরের সদর্থক মনোভাব, শিক্ষা দফতর থেকে নিয়মিত পরিদর্শন, এবং সর্বোপরি বিদ্যালয়ের পরিবেশ যাতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, সেই ব্যবস্থাই করতে হবে। তার পর তো শিক্ষা।

অরুণ কুমার মণ্ডল, হেলান, হুগলি

আনন্দের পাঠ

কুমার রাণার প্রবন্ধটি থেকে বোঝা যায় যে, শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করার জন্য কিছু পরিকল্পনা করা দরকার। পড়ানোর বা বোঝানোর জন্য প্রকৃতি থেকে পাঠ নেওয়া প্রয়োজন। সব শিক্ষকের মধ্যে হয়তো সমান কর্মতৎপরতা নেই, তবু তাঁরা ছাত্রদের আদর দিয়ে ভরিয়ে দিলে ছেলেমেয়েরা অবশ্যই স্কুলে আসবে। প্রতিটি স্কুল যেন নিজের মতো পরিকল্পনা করে, স্বাধীন মতামত দিয়ে, ছাত্রস্বার্থে উদ্ভাবনী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এক সঙ্গে খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও পড়ালেখার মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেটা যেন শিশুরা বুঝতে পারে। তা হলে স্কুলে হাজিরা বাড়তেই থাকবে। সকলের দৃষ্টি থাকুক শিশুদের দিকে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসুক এবং আদর্শ মেনে সমাজ-জীবনে চলার উপযুক্ত হোক।

দিলীপ কুমার চন্দ্র, গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন