বাংলাকে রোমান লিপিতে পরিবর্তনের অসুবিধা আছে। সেটা বাঙালিদের স্বাভাবিক উচ্চারণভিত্তিক হয় না। তাই এক দিন এই রোমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়েছেন ‘টেগোর’; কিংবা সত্যজিৎ রায় হয়েছেন ‘রে’। এটা তো আর দু’চার কথায় পাঠানো এসএমএস-এর ভাষা নয়। ‘ত’-এর জন্য না-হয় লেখা হল t, কিন্তু ‘ট’-এর জন্য কি লেখা হবে? ‘অ’ এবং ‘আ’-কে না-হয় একটা a আর দুটো aa দিয়ে তফাত করা গেল। কিন্তু ‘অ্যা’-কে রোমানে কোন লিপি দেব?
রবীন্দ্রসংগীতের একটি কলি— ‘এখন আমার বেলা নাহি আর’। কিন্তু বাঙালিদের স্বাভাবিক উচ্চারণে তা হল— ‘অ্যাখোন আমার ব্যালা নাহি আর’। রোমীয় লিপিতে বাংলা রূপান্তরিত হলেও এই উচ্চারণ নির্দেশ কচি-পাঠক কীভাবে পাবে?
আজকের পৃথিবীতে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার ভাষা আছে। অধিকাংশ ভাষারই নিজস্ব লিপি আছে। ইচ্ছা থাকলেও এক জন মানুষের পক্ষে এত ভাষা জানা সম্ভব নয়। সব ভাষাকে এক ভাষায় পরিণত করা যায় কি না, এ-নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। কৃত্রিম ভাবে সর্বজনীন লিপি হিসাবে এক সময় ‘এসপেরান্তো’ নামক বিশ্বভাষার জন্ম হয়েছিল। বেশ কিছু গুণিজন এই ভাষা শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু প্রসার তেমন একটা হয়নি।
পোল্যান্ডের চক্ষু চিকিৎসক জাইমেন হফ, এক বিশ্বভাষার দাবি করেছিলেন। সমস্যা সমাধানের জন্য ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ধ্বনিবিজ্ঞান-শিক্ষক সংস্থা ‘The Phonetic Teacher’s Associan’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখান থেকেই তৈরি হয় ‘L’ Association Phonetique Internationale ’। তারাই ১৮৮৮ সালে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা তৈরি করে। যাকে সংক্ষেপে বলে আইপিএ। তাও বেশ অনুশীলনসাপেক্ষ।
অন্য লিপিতে লেখা হোক, কিন্তু তা যেন অবশ্যই বৃহত্তর রাঢ়ী বাংলা উপভাষার উচ্চারণ অনুযায়ী হয়। নইলে অবাঙালি লতা-আশার কণ্ঠে বাংলা গান শুনে বাঙালির অন্তরাত্মা শান্তি পাবে না।
রমজান আলি বর্ধমান
হরফ বদলাক
যাঁরা মনে করেন বাংলা হরফ আছে তাই বাংলা ভাষা বেঁচে আছে, তাঁদের সঙ্গে একমত নই। ওডিয়া ভাষা হরফ বদল করেও দিব্যি বেঁচে আছে। কেউ বলবেন রোমান হরফ আনলে তার দ্বারা উচ্চারণ ঠিক ভাবে প্রতিফলিত হবে না। খানিক সত্য বটে! তবে এ-সমস্যার সমাধান একটু ভাবলেই বেরিয়ে যাবে, হয়তো কিছু নতুন নিয়ম বানাতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলা হরফ ব্যবহার করেও কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ভুল উচ্চারণ হয়। লিখি ‘কলকাতা’ আর উচ্চারণ করি ‘কোলকাতা’। লেখা হয় ‘পদ্ম’, উচ্চারণ করা হয় ‘পদ্দ’। যদি সকল ভারতীয় ভাষার জন্যে একটি (অতিরিক্ত) সাধারণ রোমান হরফ গ্রাহ্য হয়, তা হলে যেখানে-সেখানে যে-কোন ভাষার বই অল্প খরচে ছাপাতেও পারা যায়।
স্বপনকুমার সাহা কলকাতা-৮৪
কিন্তু সৌন্দর্য?
রোমান হরফে বাংলা লিখলে হয়তো অনেকের লিখতে বা শিখতে অনেক সুবিধে হবে, কিন্তু বাংলা হরফের সৌন্দর্যটা যে চির কালের জন্য হারিয়ে যাবে! যে-কোনও সৌন্দর্য আয়ত্ত করতে গেলেই তো কিছু কষ্ট করতে হয়। শুধু চটজলদি সুবিধের দিকে তাকিয়ে কি একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে?
মিথিলেশ সেন কলকাতা-৩১
অক্ষর শহর
সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজন সাধারণত শ্রীরামপুর শহরকে ‘অক্ষর শহর’ নামে ডাকতে পছন্দ করেন। কারণ, এই শহরেই প্রথম বাংলা হরফ তৈরি হয়েছিল। এখান থেকেই প্রথম বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। দুঃখের কথা, এহেন শ্রীরামপুর শহরে সরকারি, বেসরকারি একাধিক জায়গায় বাংলা বানান ভুলের ছড়াছড়ি। শ্রীরামপুরের রেল প্ল্যাটফর্মে ওঠার দুটি সাবওয়েতেই দীর্ঘ দিন ধরে লেখা রয়েছে ‘ভূর্গভস্থ পথ’। ঠিক বানানটি সকলেই জানেন, হবে, ‘ভূগর্ভস্থ পথ’। মৌখিক ভাবে রেলকর্তৃপক্ষকে অনেক দিন ধরে বলছেন অনেক শহরবাসী। কিন্তু বানান সংশোধন করা হয়নি।
সমীর সাহা শ্রীরামপুর, হুগলি
হিন্দি আগ্রাসন
চলে গেল আরও এক একুশে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার অধিকারের লড়াইকে গৌরবময় করেছিলেন যে-ভাষার সেনানীরা, সেই বাংলার দুরবস্থা প্রতিনিয়ত জনজীবনে দেখে দুঃখ পাই। ত্রিভাষা সূত্রের নামে সুকৌশলে হিন্দি চাপিয়ে বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তবু দক্ষিণের রাজ্যগুলির প্রতিবাদ, গর্জন কিংবা ওডিয়াদের মাতৃভাষার জন্য মমত্ব আছে। কিন্তু বাঙালির অাছে বাংলার প্রতি অদ্ভুত এক উদাসীনতা। প্রত্যন্ত গ্রামীণ রেল স্টেশনে সমান সময় হিসাব করে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে ঘোষণা শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, বিরক্তিকর ও অপমানজনকও। একই ভাবে গ্রামের বুক চিরে যাওয়া জাতীয় সড়কে বাংলার জায়গায় কেবল হিন্দি-ইংরেজির ব্যবহার অতিচালাকি। নোটবন্দি নিয়ে চিৎকারের মধ্যে অসম্ভব ধূর্ততায় নতুন নোটে দেবনাগরী সংখ্যার প্রচলন করা হল। এই ঘটনা কাউকে বিক্ষুব্ধ করল না।
অথচ উলটো অভিজ্ঞতা হয় যখন দেখি বিহারের বরৌনি কিংবা হরিয়ানার পানিপথের মতো বড় স্টেশনেও শুধুমাত্র হিন্দিতে বারবার রেলের ঘোষণা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অথবা অন্য কেন্দ্রীয় পরিষেবায় বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষার বড় দুর্দিন এখন। কলকাতা ভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব রেলে বাংলাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে, পূর্ব রেলে অবস্থা অতটা খারাপ নয় বোধহয়। তবে প্রতিরক্ষার জায়গায় বাংলা নৈব নৈব চ। বস্তুত হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের প্রবক্তারা এ-ভাবেই আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ভাষা বলি দিয়ে জাতীয় সংহতির দিবাস্বপ্ন দেখেন। আসলে বেসরকারি ক্ষেত্রের দ্বিভাষানীতি অনুসরণ করা এখন জরুরি, যেখানে ব্যবসার প্রয়োজনেই দুটি মাত্র ভাষা (আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক) ব্যবহার করেই কাজ হয়ে যায়। এই নীতি না মানলে হিন্দি আগ্রাসন বাড়বে আর মাতৃভাষা দিবসের বিলাপ বৃথা যাবে।
শমীকরঞ্জন সামন্ত পরমানন্দপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
রুখে দাঁড়ান
বাঙালির একটা অসুবিধা হল, সে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকে কোনও কাজ করতে গেলেও, অনেকক্ষণ ধরে ভাবে, এটি উচিত-কাজ কি না। এই অভ্যাস প্রশংসনীয়, কিন্তু যখন এই ভাবতে গিয়ে সে আত্মরক্ষার কাজেও গাফিলতি করে ফেলে, তখন হয় বিপদ। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচাবার অন্যতম পদক্ষেপ হিসাবে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কয়েক জন বাঙালি চেষ্টা করেছিলেন, যাতে কলকাতায় দোকানের নাম সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা হয় (তাঁরা বলেননি ‘বাংলাতেই’ লিখতে হবে, বলেছিলেন ‘বাংলাতেও’ লিখতে হবে), তাঁদের প্রাদেশিক বলে গাল দেওয়া হয়েছিল, অনেক বিদ্রুপ করা হয়েছিল। উদারতা নিশ্চয়ই ভাল, কিন্তু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরিকল্পিত ভাবে চেপে দেওয়া হচ্ছে দেখেও প্রতিরোধ গড়াটাকে যদি সংকীর্ণতা বলা হয়, সেটা একটু বাড়াবাড়ি পণ্ডিতি হয়ে গেল না? যে-ভাবে ইংরেজি ও হিন্দির দাপটে বাংলা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, অবিলম্বে রুখে না দাঁড়ালে বিপদ। তার বদলে শৌখিন উদারতা নিয়ে মত্ত থাকলে, কিছু দিন পরে সেরেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, একটা সুমহান ভাষা ও তার সংস্কৃতি কী ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
মলয় সেনগুপ্ত কলকাতা-৬৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়