ভারত এক গভীর দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে। বারংবার চরমপন্থী শক্তির নির্মম আঘাতে আমরা ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি। এ বারে কাশ্মীরের পহেলগামে রক্তাক্ত হয়েছেন নিরীহ পর্যটকরা। এই হামলা ছিল ব্যতিক্রমী, কারণ সাধারণ মানুষকে নিশানা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। এক দিকে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প যা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তাকে ধ্বংস করা হল। অন্য দিকে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আগুনকে নতুন করে উস্কে দেওয়া হল। দেশের হৃদয় বিদীর্ণ এই নির্মমতায়। ২৬ জন নিরস্ত্র নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র দেশের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করাটা প্রয়োজন ছিল। সদ্য পাকিস্তানের জঙ্গিঘাঁটিগুলিকে লক্ষ্য করে ভারত আকাশ-পথে প্রত্যাঘাত হেনেছে। কিন্তু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দেশে যে ক্ষুদ্র বিভাজনের সৃষ্টি হল, ‘অমৃতকাল’-এর ভারত কি পারবে সেই দাগ মেটাতে?
আসলে, অমৃতকালের এই নতুন ভারতে নেতা তাঁর ইচ্ছামতো কথা বলেন, আর জনগণকে তাঁর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতে হয় ‘মন কি বাত’ বা কোনও নির্বাচনী প্রচারের শব্দের মারপ্যাঁচের ভিতর থেকে। এখন মানুষ নিজেদের ক্ষোভ উগরে দেন কাশ্মীরি ছাত্রদের উপর, রাস্তায় হেঁটে চলা সাধারণ মুসলিমদের উপর, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী এবং সরকার সমালোচকদের উপর। যাঁরা সাহস করে প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়, অথবা চতুরতার সঙ্গে তাঁদের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা হয়। নানা সংবাদমাধ্যম এখন রুটিন সরকারি কর্মসূচিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মন্ত্রিসভা বৈঠককেই বিরাট অর্জন-রূপে তুলে ধরে। সংবেদনশীলতার পরিবর্তে আজ আমাদের মনকে সাজানো হচ্ছে যুদ্ধের সাজে, কল্পনাকে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে উত্তেজনার বারুদে।
গৈরিকীকরণের জোয়ারে ভারত হারিয়েছে অনেক কিছু। আমরা হারাতে বসেছি যুক্তির শক্তি। আবেগ আমাদের যুক্তিবোধের স্থান দখল করেছে। অভূতপূর্ব নির্বুদ্ধিতার দিকে ধেয়ে চলেছি। সেখানে প্রশ্ন নয়, অন্ধ আনুগত্যই একমাত্র সত্য।
অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
সুযোগ দিন
বহু বছর পরে কাশ্মীরে পর্যটনের আবহ স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। তা নষ্ট হয়ে গেলে কর্মহীনতার যে শূন্যতা তৈরি হবে, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি লোকসংগ্রহের সুযোগ হিসাবে তার ব্যবহার করবেই। কাশ্মীর যদি ভারতের মূলস্রোতে মিশতে না পারে, এবং স্বাভাবিক জীবিকার সুযোগ তৈরি না হয়, তবে সমস্যার সমাধান কখনওই সম্ভব হবে না।
অবস্থার উন্নতি হলে ভারত সরকার একটি নিরাপদ ভ্রমণ প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে পারে। পর্যটকেরা আগে থাকতে ট্রিপ বুক করবেন, জনাপঞ্চাশেকের এক-একটি দলে তাঁদের ভাগ করা হবে। সকলে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাশ্মীরে এলে, তাঁদের বিমানবন্দর বা অন্য কোনও স্থান থেকে নিয়ে বিশেষ বাসে চড়ে ক’দিন ঘুরিয়ে আবার বিমানবন্দর বা কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী থাকবে— এতে অতর্কিত আক্রমণের সুযোগ থাকবে না। এতে কাশ্মীরের পর্যটন কিছুটা হলেও বাঁচবে এবং প্রধান কেন্দ্রগুলো সেনার নজরেও থাকবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পর্যটন-উদ্ভূত আয় যা হতে পারত, তা হয়তো হবে না, কিন্তু বন্ধ হওয়ার চেয়ে তো ভাল।
কাশ্মীরবাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছবে যে ভারত সরকার তাঁদের দিনান্তে রুটির ব্যবস্থা করতে তৎপর। সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষে বৃত্তিহীন ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীর হাতে সুকৌশলে বন্দুক ধরানোটা সহজ। এই ব্যবস্থায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোও টের পাবে যে কাশ্মীরে তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে না। দায়িত্বশীল ও অপ্রতিহত রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে ভারত পৃথিবীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
অনমিত্র বিশ্বাস, আইআইটি ভিলাই, ছত্তীসগঢ়
মেলাতে পারি না
বৈসরনে জঙ্গি হামলার ছবিগুলো দেখে খুব অস্থির লেগেছে। মনে পড়ছে, ওই সবুজ গালিচা পাতা উপত্যকাতেই তো একটা দিন কাটিয়েছিলাম। ২০১১ সালের অক্টোবরে আমরা কাশ্মীর-ভ্রমণে বেরিয়ে শ্রীনগর, সোনমার্গ, গুলমার্গ হয়ে পহেলগামে পৌঁছেছিলাম। রাস্তার উপরেই হোটেল। রাস্তাটা পার হলে শেষনাগের জলরাশি। সরু কিন্তু খরস্রোতা। দুই পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো, দু’দিকে নানা রকম ফুলের গাছ লাগানো। প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত পহেলগামের রাস্তায় নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ালাম। রাস্তায় প্রহরায় রয়েছে সেনা, বিএসএফ, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। পর দিন খুব ভোরে বৈসরন গেলাম। জায়গাটার শুধু নামই শুনেছি। কিছুই জানি না। শুধু জানি, সকালে ঘোড়ায় চেপে খাড়াই পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উঠতে হবে।
সকাল সকাল রওনা হলাম। দেখি, নদীর পারে কসরত করছেন জওয়ানরা। সঙ্গেই দিব্যি যোগ দিয়েছে ওঁদের কুকুর। কিছু দূর গিয়ে তার পর ঘোড়া ভাড়া নিতে হয়। এক জন লোক তিনটি ঘোড়া নিয়ে সবে বেরিয়েছেন, বললেন— “এখনও বউনি-বেলা, দোকানও খোলেনি, আপনাদের কমেই নিয়ে যাব।” তিনটে ঘোড়ায় আমরা স্বামী-স্ত্রী ও আমাদের ছেলেকে চাপিয়ে সহিস রওনা দিলেন। কিছুটা পথ পেরিয়ে শুরু হল চড়াই ভেঙে উপরে ওঠা। লম্বা লম্বা পাইন, ফার, দেবদারু গাছের ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, সরু সুতোর মতো নদী পিছনে ফেলে আমাদের তিন বাহন টুকটুক করে উপরে উঠছে! গাছে ঘেরা, আলো-ছায়ার পথ পেরিয়ে অবশেষে বৈসরন ভ্যালিতে পৌঁছলাম। বরফে ঢাকা পাহাড় দিয়ে ঘেরা বৈসরন যেন পাইন বনের মাঝের সবুজ আবির ছড়ানো একটা উপত্যকা। খুব সকালে গিয়েছিলাম, তখন আমরা তিন জন ছাড়া মাত্র জনাকয়েক পর্যটক এসেছেন। যেমন সুন্দর উপত্যকা, তেমনই সুন্দর ওখানকার মানুষরা। খুবই দরিদ্র, কঠোর পরিশ্রম করে দিন চলে, অথচ মুখে হাসিটি লেগেই রয়েছে। দেখি, একটি ছোট্ট মেয়ে দু’টি খরগোশ নিয়ে ঘুরছে, তার খরগোশ নিয়ে যদি কেউ ছবি তোলে, কিছু উপার্জন হয়। আমি ছবি তোলার এই সুযোগ হাতছাড়া করিনি।
কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে কাগজে, টিভিতে বৈসরনের যে ছবি দেখেছি, মনের ভিতর তোলপাড়। স্বর্গ যে আজ নরক হয়ে গেল!
সুমিত্রা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৫
আশা-নিরাশা
২০১৫-র ঘটনা। যাচ্ছিলাম জম্মু থেকে কাশ্মীর, গাড়িতে। বিকেল চারটে নাগাদ পহেলগামের কাছে জওহর টানেলে সন্ত্রাসবাদীদের গোলাগুলি চলছিল। গাড়ি থেমে গেল। সারা রাত সেখানে ঝড়-বৃষ্টিতে আটকে, পরের দিন কাশ্মীর গিয়েছিলাম বিমানে। কাশ্মীরের নানা স্থানে যাওয়ার রাস্তাগুলি প্রায়ই বন্ধ করে রাখা হত। পহেলগাম আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
আজ কত রক্ত আর চোখের জলে চিরতরে ভিজে রইল বৈসরনের জমি। কিন্তু প্রশ্নগুলি তো থেকেই গেল। এত কিছুর পরেও কাশ্মীর কেন সন্ত্রাসবাদ মুক্ত হয়নি? গোয়েন্দারা কেন এ ভাবে ব্যর্থ হলেন? সেখানে কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক ছিল না? ঘটনাস্থলের কাছে ছিল লিডার নদী ও তার পার্শ্ববর্তী উইলো পপলারের জঙ্গল। সেখানকার স্থানীয় মানুষ, টাট্টুচালক থেকে শুরু করে গাইডরা রক্তাক্তদের পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নিজের দেহের রক্ত দিয়ে, তাঁরা তো উগ্রপন্থী নন। তাঁদের জীবিকায় কেন আঘাত নেমে এল?
আজ সব কিছুতেই ঘন মেঘের ছায়া। কত পর্যটকের টিকিট কাটা ছিল। কেউ যেতেন পহেলগাম হয়ে অমরনাথ, কেউ বা শুধু কাশ্মীরই ঘুরতেন। একটি দল ঘটনার সময় বেতাব ভ্যালিতে ছিল, গোলাগুলির কথা শুনে ফিরে এসেছে। সে কথা মনে পড়লে, তাঁরা আজ বার বার কেঁপে উঠছেন।
শান্তির জন্য অনেক দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য। দ্বেষ নয়।
বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, ফুলিয়া কলোনি, নদিয়া
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে