বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমী প্রাণী গবেষক-লেখক যুধাজিৎ দাশগুপ্তের একটি আকর্ষণীয় প্রবন্ধ পড়ে অভিভূত হয়েছি। শিরোনাম ‘রং হারাচ্ছে প্রজাপতিরা’ (রবিবাসরীয়, ৯-১১)। প্রজাপতি নিয়ে চিরকালই কবিদের উৎসাহের কমতি নেই। কাজী নজরুল লিখেছেন, “প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা,/ টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকা বাঁকা।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছন্দে বেঁধেছেন— “ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ। আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥” তবে রবীন্দ্রনাথ কখনও কল্পনা করতে পেরেছিলেন কি যে প্রকৃতির এই বিশুদ্ধ দান এবং সৌন্দর্যকে তাঁর উত্তরসূরিরা হারাতে বসবে? বিশিষ্ট সুরকার সলিল চৌধুরী পর্যন্ত বর্ষায় ব্যাঙের ডাক নিয়ে কী মজার গান বেঁধেছিলেন— “ও সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ, সারারাত হেঁড়ে গলায় ডাকিস গ্যাঙর গ্যাঙ!” সেও কি ভবিষ্যৎ আর শুনবে? আরও জানতে পারলাম যে আমাদের পরিচিত গাপ্পি আদতে ব্রাজ়িলের, মশার বংশ ধ্বংস করার জন্য এ দেশে প্রথম ব্রিটিশরা আমদানি করেছিল তাকে। প্রকৃতির এই অকৃপণ দান আমরা জ্ঞানে এবং অজ্ঞানে হারাতে বসেছি। আলোচ্য প্রবন্ধে তা সুন্দর বর্ণিত হয়েছে।
পরিশেষে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী বৈশালী সরকারের আঁকা ছবি নিয়ে বলতে চাই যে প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া সেই বেদনাও শিল্পীর তুলিতে অপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। আসলে আমরা জানি আকাশে রামধনু দেখা যায় সূর্যের উল্টো দিকে, যদি কালো মেঘ জমে তাতেই রামধনুর সাতটি রং সুন্দর ফুটে ওঠে। কিন্তু ছবিটায় দেখলাম নীল রঙের আকাশের মধ্যে রামধনুর দেখা মিলছে, যা আস্বাভাবিকতার রূপক।
বাঁধন চক্রবর্তী, আগরতলা, ত্রিপুরা
বিষফল
রামধনু দেখি না বহু দিন। শৈশব যত দূরে চলে যায়, বোধ হয় প্রাকৃতিক এমন অনেক উপাদান তো হারিয়েই যায় জীবন থেকে। বয়স নয়, এ ক্ষেত্রে খলনায়ক যে উষ্ণায়ন, জানতে পেরে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি লাগল। মেরুপ্রদেশে তুষার হয়ে জমার বদলে বাতাসে ভেসে বেড়াবে অনেক বেশি জলকণা। সেখানে দেখার চোখ বিরল হলেও রামধনু রংমিলান্তি জাদু দেখাবে অনেক বেশি। যুধাজিৎ দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘রং হারাচ্ছে প্রজাপতিরা’ এমন অনেক তথ্য বিছিয়ে দিল সামনে।
রামধনুর পরেও আরও কত প্রসঙ্গ এসেছে। ময়ূর, জোনাকি, রঙিন মাছ, সমুদ্রতটবাসী কাঁকড়া— এমন বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ মাছ ও পাখির শারীরিক গঠন, বিশেষ করে গাত্রবর্ণে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সভ্যতার দোসর আলোর বন্যার জন্য বা কোনওখানে তার স্বল্পতার ফলে প্রকৃতির সন্তানদের যাপনের ছন্দ বিড়ম্বিত হয়ে এক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে। মাছের রুপোলি ঝিলিক উধাও। একই প্রজাতির মধ্যে স্বাভাবিক মিলন অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। উষ্ণ হয়ে ওঠা ধরিত্রী, জাহাজ চলাচলের শব্দ, নদী ও সমুদ্রের জলে নানা রাসায়নিক বর্জ্য নিক্ষেপ ও অনিয়ন্ত্রিত আলোর ব্যবহার কীট-পতঙ্গ ও পক্ষীদের জগতে প্রভূত ক্ষতিসাধন করছে। বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্যহীনতার কারণে নানা বিষময় ফল ফলছে প্রকৃতি ও কীট-পতঙ্গের জগতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই গন্ডগোলের সূচনা মানুষের হাতে এবং ক্ষতি ও অপকারের মোট ফলাফল শেষ পর্যন্ত মানুষের ভাগে এবং দুর্ভাগ্যের কোঠাতেই জমা পড়বে।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
স্বখাত সলিল
‘ষষ্ঠ রিপুর বশে’ (২-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ বা পরশ্রীকাতরতার প্রতি নিয়ন্ত্রণ বা সে শৃঙ্খল হতে মুক্তি যে মোক্ষলাভের পথ তা যথার্থ ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। মানুষ যখন এই ষড়রিপুর ষষ্ঠরিপু মাৎসর্যের জাল থেকে বার হতে পারে তখনই বোধ হয় মহামানবের আখ্যায় ভূষিত হয়। তবে সেটা কেবল নিরন্তর সাধনার ফলেই সম্ভব হতে পারে। তবে মানুষ অবশ্যই ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণাধীন রেখে কিছুটা হলেও এর কবল থেকে বার হতে পারে এবং শান্তি প্রাপ্তির চেষ্টা করতে পারে।
তবে, হালফিলের সমাজে পরশ্রীকাতরতা সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু। অনেক মানুষ আজ অপর কোনও মানুষের প্রগতিশীল কাজকেও আর ভাল চোখে দেখে না। কিছু মানুষ আবার অন্যের ভাল কাজের পিছনে অন্য কোনও কারণ বা উদ্দেশ্য খুঁজে পেলে খুশি হয় বা তার ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা প্রচার করে। অন্তর থেকে কারও ভাল কাজের প্রশংসা বা বাহবা জানানোর কথা আজ মানুষ ভুলতে বসেছে। পরশ্রীকাতরতায় সমসাময়িক বহু মানুষ বাংলার মহামানবদেরও, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ও বিবেকানন্দের নামে অপপ্রচার করতেও পিছপা হয়নি। সমসাময়িক কিছু কবির বিদ্বেষজনিত মনোভাব বা সমালোচনা প্রায়ই রবীন্দ্রনাথকে বিদ্ধ করত।
শিকাগো শহরে বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনে হিন্দুধর্মের মহাপ্রচার করার পর জগৎজোড়া খ্যাতি দেখে নিজের দেশের মানুষও স্বামী বিবেকানন্দের সমালোচনা কটূক্তি করতে ছাড়েনি। বিবেকানন্দ নিজে বলেছিলেন যে “এই দুর্ভাগা হিন্দুজাতি পরস্পরের প্রতি যেরূপ জঘন্যভাবে ঈর্ষান্বিত এবং পরস্পরের খ্যাতিতে যেভাবে হিংসাপরায়ণ, তাহা কোন কালে কোথাও দেখা যায় নাই।”
পরশ্রীকাতরতা মানসিক শান্তি বা সুখের অন্তরায়। তবু মানুষ তার নিজের সীমাবদ্ধতা বা যোগ্যতার মাত্রা নিয়ে ভাবেই না। মহাভারত-এ যেমন পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের পরশ্রীকাতরতার চরম পরিণাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তেমন রামায়ণ-এ রামের প্রতি কৈকেয়ীর পরশ্রীকাতরতার পরিণাম রামের বনবাস, সীতাহরণ ও রাম-রাবণের যুদ্ধ। ভরতের জন্য কৈকেয়ী যা চেয়েছিলেন, তাতে সফল-মনোরথ হতে পেরেছিলেন কি?
এখন তো ভালবাসা, কর্তব্যবোধ, দায়িত্ব, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা শব্দগুলি ঈর্ষার বিষে ভরা পৃথিবীতে একেবারে অনর্থক হয়ে পড়েছে। নিন্দা বা অপবাদ ছড়ানোর বা কাউকে অহেতুক আঘাত করার লোক ক্রমশ বাড়ছে। ফলে সমাজ ভারসাম্যও হারাচ্ছে। কারণ অজানতেই সেই নিন্দুক বা পরশ্রীকাতর মানুষরা নিজেদের ও অন্যদের ধ্বংসের পথ খুঁড়ে ফেলছে। পরের উন্নতি বা শ্রীবৃদ্ধিতে ঈর্ষাকাতর হয়ে প্রতিটি মানুষ যদি তার যোগ্যতা বা সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় না রাখে ও অসুখী, অতৃপ্ত থাকে তবে সভ্যতা ও মানবতা এক নব মহামারিতে ভুগবে। ঘৃণার মহামারি। যার প্রকোপ শুরু হয়ে গিয়েছে।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা- ১৫০
নিষ্পেষণ
জয়দীপ বিশ্বাস (২৮-১০) ‘গণদেবতার এজলাসে’ প্রবন্ধে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ, আইনের নানা বিধি ও ধারার উল্লেখ করে জানিয়েছেন ভোটার তালিকার সংশোধন এবং পরিমার্জনের দায়িত্ব ও অধিকার নির্বাচন কমিশনের। এ বিষয়ে কিছু কথা।
গত ৬০-৬৫ বছরে ভোটার তালিকার নানা সংশোধন বা পরিমার্জনে ‘বিশেষ’ শব্দটি এই ভাবে জনমানসে এত বিভ্রান্তি ছড়ায়নি। স্বাধীনতার পরের প্রথম নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভোটার তালিকাকে স্বচ্ছ রাখতে বারে বারেই পরিমার্জনের প্রয়োজন হয়েছে, যাকে আমরা ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বলে জানতাম। ‘বিশেষ’ কথাটাকে আগে প্রচারিত হতে দেখিনি। তা ছাড়া, ব্যক্তির নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সব দায় রাষ্ট্র নির্বাচন কমিশন অনুমোদিত এগারো দফা নথির ভিত্তিতে নাগরিকের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। যা কিন্তু নাগরিকের ‘মতদানের অধিকার’, ‘নেতা নির্বাচনের অধিকার’-এ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, স্বল্প সময়ের মধ্যে কমিশন নির্ধারিত কয়েকটি কাগজ দেখিয়ে ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণে বাধ্য করার এক নির্মম চাপ— আদৌ কি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? বা, তা কি গণতন্ত্রসম্মত?
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৬৩
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে