যে উদার সংস্কৃতি দুই বাঙালির তৈরি

ধর্ম নয়, নিজের ভাষা-সংস্কৃতিই বাঙালির বড় আপন। এই সংস্কৃতি দুই বাঙালির তৈরি। এই সংস্কৃতি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরোধী, সামাজিক রক্ষণশীলতার বিরোধী। একটি নতুন উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা।বাংলা নববর্ষ বাঙালির নববর্ষ। কিন্তু বাঙালি কারা? প্রশ্নটা থেকে থেকেই ওঠে। প্রশ্নটার মুখোমুখি হওয়া দরকার ইতিহাসের দিক থেকেই। বিশেষ করে দুই বাংলায় এখন মাঝে মাঝেই ধর্মের জিগির ওঠে, যেন হিন্দুয়ানি আর মুসলমানির দিকটাই বাঙালিয়ানার থেকে বড়। বহু হিন্দু বাঙালির অবচেতনে এখনও শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই বাক্যটি খেলা করে যায়, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।’

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০২
Share:

নববর্ষ। ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। ছবি: এএফপি।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির নববর্ষ। কিন্তু বাঙালি কারা? প্রশ্নটা থেকে থেকেই ওঠে। প্রশ্নটার মুখোমুখি হওয়া দরকার ইতিহাসের দিক থেকেই। বিশেষ করে দুই বাংলায় এখন মাঝে মাঝেই ধর্মের জিগির ওঠে, যেন হিন্দুয়ানি আর মুসলমানির দিকটাই বাঙালিয়ানার থেকে বড়। বহু হিন্দু বাঙালির অবচেতনে এখনও শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই বাক্যটি খেলা করে যায়, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।’ একই ভাবে অনেক মুসলমান ভাবেন কাঁকনডুবি গ্রামের মতির মতো করে, ‘মালাউনদের খেদমত করে কী হবে?... মালাউনদের সাহায্য করলে কোনো সওয়াব নাই।’ শ্রীকান্ত ১৯১৭-তে বই হয়েছিল, আর কাঁকনডুবির মতি ১৯৭১-এর চরিত্র। বইতে তাঁর জায়গা হয়েছে অবশ্য এই বছরের গোড়ায়। ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইটি ২০১৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও-বাংলার বাঙালি পড়ছেন। রাজাকার মতিদের ভেদবুদ্ধির শাস্তি চান তাঁরা। হিন্দু বা মুসলমান হলে বাঙালি হওয়া আটকাবে কেন? অথচ এই ভুল বাঙালি মাঝে মাঝেই করেন, বাঙালি বাঙালির সঙ্গে ধর্মের নামে লড়েন। ভুলে যান, ধর্ম নয়, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিই তাঁদের আত্মপরিচয়ের মূল। ভুলের ফলেই তো এই উপমহাদেশে এক বাঙালি দুই হয়েছিল।

Advertisement

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা দীনেশচন্দ্র সেনের ডাক পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বক্তৃতা দিতে হবে। দীনেশচন্দ্রের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’। এমনিতে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ১৯৩৭ বেঙ্গল প্রভিন্সে বেশ সমস্যাবহুল সময়। মুসলিম লিগ, কৃষক প্রজা পার্টি, কংগ্রেস— তিনের টানাপড়েন চলছে। ১৯৩৭-এ জাতীয় কংগ্রেস নেতারা স্থির করলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ সংগীতের একটি অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে গাওয়া হবে। গানটির ঐ অংশের পৌত্তলিকতা ভারতীয় মুসলমানদের আপত্তিজনক, তাই এই সিদ্ধান্ত। দীনেশচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতায় আধুনিক হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের এই জটিলতার বিপরীতে বাংলা ভাষার পুরনো সাহিত্যের নজির হাজির করেছিলেন । তিনি বার বারই বলছিলেন, ইংরেজ উপনিবেশ পর্বে হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি পরস্পরের সঙ্গে যে লড়াই করছে, সেই ভেদবিভেদের ইতিহাসের থেকে হিন্দু আর মুসলমান বাঙালির মিলনের ইতিহাস অনেক পুরনো, অনেক দীর্ঘ। বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি, যার উপর নির্ভর করে বাঙালি বাঙালি হয়ে উঠেছিল, তাতে হিন্দু-মুসলমান দুইয়েরই অবদান আছে। তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘বাঙ্গালার জনসাধারণ বলিতে কাহাদিগকে বুঝিতে হইবে ?’ দীনেশচন্দ্র নিজেই সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ইহারা জৈন নহেন, বৌদ্ধ নহেন, খৃষ্টান নহেন, হিন্দু নহেন, মুসলমান নহেন— ইঁহারা বাঙ্গালী।’

ইংরেজ আমলে উনিশ শতকে বঙ্গদেশে বঙ্কিমচন্দ্র গলা ছেড়ে বাঙালির ইতিহাস লেখার ডাক দিয়েছিলেন। সেই ইতিহাসে বাঙালি মুসলমানদের জায়গা কী হবে তা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব ছিল স্পষ্ট। বঙ্কিম মনে করতেন ত্রয়োদশ শতকে মুসলমান আক্রমণে সেন রাজাদের পরাজয় তাঁর জন্মভূমির পক্ষে চরম বিপর্যয়। যতই তাঁর লেখায় রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখের নাম পাশাপাশি থাকুক না কেন, তাঁর চিন্তায় বাঙালি মুসলমানরা যেন এক রকম ভাবে বাদ পড়ে যান।

Advertisement

দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩৭-এ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিক দিয়ে সেই ফাঁক পূর্ণ করতে সচেষ্ট। বাংলা ভাষা-সাহিত্য তো সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের মতো পুরনো নয়। মোটামুটি কম-বেশি দশম শতাব্দী থেকে তার চলাচল শুরু। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান আক্রমণের সময় বাংলা ভাষার সাহিত্য নিদর্শন তেমন বিপুল নয়। পরে মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য গড়ে উঠল সেই সাহিত্য কিন্তু কেবল হিন্দুরা রচনা করেননি, মুসলমানরাও রচনা করেছিলেন। মুসলমান শাসকেরাও অনেকেই বাংলা ভাষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। সেই পৃষ্ঠপোষণা জাতি হিসেবে বাঙালিকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। মুসলমানদের মধ্যে মধ্যযুগে যাঁরা বাংলা ভাষা সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন তাঁদের বাঙালি মুসলমান কবিরা রীতিমতো ধমকও দিয়েছিলেন। নোয়াখালির কবি আবদুল হাকিম সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘নূরনামা’য় লিখেছিলেন, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সবায় কিবা রীতি নির্ণয় না জানি।।/… দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায় ।/ নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায়।।’

হিন্দু-মুসলমানের সখ্যে সামীপ্যে ও সাহচর্যে শস্য-শ্যামলা নদীমাতৃক ভূখণ্ডে মধ্যযুগে বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় গড়ে ওঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদী আবেগ তাতে ফাটল ধরিয়েছিল। মুসলিম লিগের রাজনীতিও বাঙালি মুসলমানদের ‘বাঙালিত্ব’কে বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়নি। ফলে দেশ ভাঙল, ধর্মের নামে দেশ স্বাধীন হল। বাঙালি মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ হল পূর্ব পাকিস্তান। ক্রমশই বাঙালি মুসলমানরা বুঝলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতির মিল নেই, আর নিতান্ত ধর্মের মিল দিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্য মুছে দেওয়া যায় না।

ইকবালের লেখা আখ্যানে কাঁকনডুবি গ্রামের মতি অবশ্য সে কথা বুঝতে চায়নি। তাকে গ্রামের লোকেরা তাই বলত ফালতু মতি। ইকবাল তাঁর দেশের বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের সহজ ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছেন। বাঙালির যে ইতিহাস উনিশ শতকে বঙ্কিম লিখতে চেয়েছেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই ইতিহাস তার থেকে অনিবার্যভাবেই আলাদা। তাঁর ঘরানাটা দীনেশচন্দ্রের মতোই। বাঙালিয়ানাটাই মুখ্য। কারণ ইকবাল জানেন এই বাঙালিয়ানা দিয়ে ধর্মের জিগিরের সঙ্গে লড়াই করা যায়, এমনকী মুক্তবুদ্ধির বিস্তারও সম্ভব। দীনেশচন্দ্রের নমুনা পুরনো বাংলা সাহিত্য, ইকবালের ভরসা সত্তর একাত্তরের বাঙালি মুসলমানদের মন। বাঙালি পাঠককে সেই মনের খোঁজ দিয়েছে রঞ্জু, সেই কিশোরের দেখায় ও কথায় গড়া এই আখ্যান। রঞ্জুর নানি রঞ্জুকে বলেছিল ‘এই মইত্যা (মতি) হারামজাদা হচ্ছে বেকুবের বেকুব! এইটা একটা কথা হলো?’ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের বিপদটা যে এক সেটা রঞ্জু ক্রমে টের পেল। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানের ‘মুসলমান’ মিলিটারিরা রেহাই দিত না। রঞ্জু শুনল বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারি অ্যারেস্ট করেছে। কাজি বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, তাদের কাঁকনডুবির সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ, তাকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। ইস্কুলবাড়ি মিলিটারি দখল করে নিল। যে বলাইকাকার চায়ের দোকানে তারা রেডিওতে বিবিসির খবর শুনে মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি জানত সেই হিন্দু বলাইকাকাকে চোখের সামনে খুন হতে দেখল সে। তাদের গ্রাম ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে
যেতে বাধ্য হল নীলিমারা। বড় হয়ে গেছে বলে যে লতিফাবুবুকে স্কুলে যেতে দিত না ধর্ম, যে লতিফাবুবুর জন্য মাসুদ ভাই দিয়েছিল আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, মিলিটারির হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুল বাড়ি মুক্ত করার পর সেই লতিফাবুবুকে আবার খুঁজে পেল রঞ্জু। খুঁজে পেল দরজা-জানলা বন্ধ একটা আবছা ঘর। সেই ঘরে ক’টি মেয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। মেঝেতে শুকনো রক্ত। লালচে চুলের এক মেয়ে রঞ্জুকে বলেছিল, ‘তোমাদের যুদ্ধ শেষ, আমাদের যুদ্ধ শুরু।’

যুদ্ধ কারওই শেষ হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস শুরু। সেই ইতিহাস বুঝিয়ে দিয়েছিল বঙ্কিমের ইতিহাসের থেকে দীনেশচন্দ্রের ইতিহাস বাঙালির বাস্তবের অনেক কাছাকাছি। ধর্ম নয়, নিজের ভাষা-সংস্কৃতিই বাঙালির বড় আপন। এই সংস্কৃতি দুই বাঙালির তৈরি। এই সংস্কৃতি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরোধী, সামাজিক রক্ষণশীলতার বিরোধী। লতিফাবুবুদের জন্য ধর্ম যে পাঁচিল বরাদ্দ করুক না কেন, আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি পড়ে বাঙালিিনরা মুক্তির কথা ভাবতে পারেন।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন