জীবাণু, তুমি কোথা হইতে

এ সব তো সবার জানা। কিন্তু যা নিয়ে আলোচনা প্রায় হয় না, তা হল বর্তমান শতাব্দীতে এই খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত কিছু মারক ব্যাধির ফিরে আসা।

Advertisement

অনমিত্র বারিক

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৮ ০১:০৯
Share:

বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে দ্রুত ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসাগুলির অন্যতম হল পোলট্রি। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাফল্যের কারণে পৃথিবী জুড়ে এই ব্যবসার রমরমা। এই ব্যবসাতে প্রতিটি প্রাণী একে অপরের সঙ্গে জিনগত সাদৃশ্য বয়ে নিয়ে চলে, তার পরে কয়েক মাস একত্রে বড় হয়, জবাই হয় এবং প্রক্রিয়াকরণের পর পৃথিবীর এ কোণ থেকে ও কোণ হেঁশেলে পৌঁছে যায়।

Advertisement

এ সব তো সবার জানা। কিন্তু যা নিয়ে আলোচনা প্রায় হয় না, তা হল বর্তমান শতাব্দীতে এই খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত কিছু মারক ব্যাধির ফিরে আসা। যেমন হেপাটাইটিস ই, কিউ ফিভার, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে এক সঙ্গে বড় করার ফলে গড়ে ওঠে এক বৈচিত্রহীন মনোকালচার, যা ডেকে আনে এই সব প্রাণঘাতী ব্যাধিকে। উনিশ শতকের কুখ্যাত আইরিশ দুর্ভিক্ষ দেখিয়েছিল, একই ধরনের চাষ অনেকটা জায়গা জুড়ে করলে মড়কের কবলে পড়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

কিন্তু বাজার অর্থনীতি মহামারি বাধানো বহুজাতিক সংস্থাকে কাঠগড়ায় তোলে না, শাস্তি পায় লক্ষ লক্ষ পাখি, পরিবেশ, উপভোক্তা আর চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত কৃষিকর্মী। এমনটাই দেখাচ্ছেন রব ওয়ালেস তাঁর বিগ ফার্মস মেক বিগ ফ্লু বইতে। তিনি সংক্রামক রোগ, কৃষিব্যবস্থা, অর্থনীতি, বিজ্ঞানের প্রকৃতিকে একত্রে বোঝবার চেষ্টা করেছেন। ওয়ালেস তীক্ষ্ণ শ্লেষে বলছেন, ধনতান্ত্রিক কৃষি এবং খাদ্য ব্যবস্থা মুরগির সঙ্গে সঙ্গে মারক জীবাণুরও অবাধ উৎপাদন করছে।

Advertisement

গত শতাব্দীর প্রথম ভাগ অবধি পোলট্রি ফার্মিংয়ে বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন জায়গায় চলত। হঠাৎ এই ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এল। বহুজাতিক সংস্থাগুলো একই ছাদের তলায় মুরগি পালন থেকে মুরগি নিধন, গোটা পদ্ধতিটাই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। ফলে অসুখের বিস্তৃতি আর বিবর্তন দুটোকেই উৎসাহ দেওয়া হল। গবেষণা দেখাচ্ছে, গণনিধন পদ্ধতি এবং সংক্রমণের যৌথ প্রক্রিয়া জীবাণুর ঘাতকশক্তিকে আরও ধারালো করছে, কমবয়সি পশুগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে ফেলছে। আগামী দিনের মারক জীবাণুর সৃষ্টি হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে শেষের গল্পটা বেশ মজার। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পোলট্রি ব্যবসা চালায় সারা চিন জুড়ে। যখন এদেরই এক ফার্মে বার্ড ফ্লু হল, জাপান চিন থেকে পোলট্রি আমদানি নিষিদ্ধ করে দিল। তাইল্যান্ডে এই গ্রুপের আর এক ফার্মের পোয়াবারো। তারা এই সুযোগে জাপানে রফতানি বাড়িয়ে ফেলল। মোদ্দা ব্যাপার হল, গোষ্ঠীটি তাদেরই তৈরি করা মড়ক দ্বারা লাভবান হল!

প্রকৃতির উপর জোর খাটিয়ে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন যে কী ভয়ানক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে তার প্রমাণ ইবোলা। ক’দিন আগে কঙ্গোর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী সরকার ঘোষণা করেছে যে, তারা আবার ইবোলা ভাইরাসজনিত মৃত্যুর প্রমাণ পেয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা কমবেশি দু’ডজন। পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ২০১৪-১৬ সালে ইবোলা মড়কের স্মৃতি আবার টাটকা হয়ে উঠল।

ইবোলা সংক্রমণের পুরো বিজ্ঞান আমাদের হাতের মুঠোয় এখনও আসেনি। কিন্তু মনে করা হয় যে, মানবদেহে প্রবেশের আগে আফ্রিকাতে ইবোলা ভাইরাস পশুদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গবেষকরা মনে করছেন যে সংক্রমিত পশুর মাংস খাওয়ার ফলে মানুষ প্রথম সংস্পর্শে আসে রোগগ্রস্ত পশুর রক্তের। পশ্চিম আফ্রিকার মানুষকে নানা ভাবে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আগ্রাসনে গ্রামীণ আফ্রিকার বনভূমি যখন কৃষিজমিতে পরিবর্তিত হতে থাকে, মানুষ ও বৃহত্তর প্রকৃতির সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটে। জঙ্গল কাটা এবং কৃষিজমির প্রসারের ফলে বাড়তে থাকে ভাইরাসের সংক্রমণ। আধুনিকতার নামে এক দিকে জবরদস্তি বন কেটে বসত বা বনভূমির কৃষিজমিতে অবাধ রূপান্তর, আর অন্য দিকে পরম্পরাগত পশুশিকার— এই ঘোর প্রক্রিয়ায় ইবোলা ভাইরাস এক প্রজাতিকে টপকে অন্য এক প্রজাতিকে ধারণ করল, আক্রান্ত হল মানুষ। আফ্রিকার বনভূমির ল্যান্ডস্কেপ বিচিত্র এবং জটিল। গ্রামগুলো সাধারণত জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে বাদুড়রা প্রাকৃতিক বাসস্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়ে বাসা বাঁধল মানুষের বসতির কাছে। সরকারি বদান্যতায় লাইবেরিয়ার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বনভূমি বেচে দেওয়া হয়েছিল পশ্চিমি শিল্পপতিদের কাছে। প্রায় চল্লিশটি বিপন্ন বন্যপ্রজাতি লাইবেরিয়ার এই অরণ্যে বাস করত। সিয়েরা লিয়নের বনভূমি অবাধ গাছ কাটার ফলে কমতে কমতে প্রায় চার শতাংশে এসে ঠেকেছে।

কয়েক দশক ধরে আফ্রিকাতে চলতে থাকা খননকার্য (হিরে ও সোনার খনি) জঙ্গল নষ্ট করে চলেছে। মানুষের যাতায়াত বেড়েছে, বেড়েছে রোগের সংক্রমণ। আইএমএফ বলছে সিয়েরা লিয়নের জিডিপি কুড়ি শতাংশ বেড়েছে। যেটা বলছে না তা হল, যুদ্ধের পরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে বেড়েছে শরণার্থীর সংখ্যা, যাঁরা পেটের তাগিদে নির্ভর করে আছেন বন্যপ্রাণীর, আর জ্বালানির জন্য জঙ্গলের উপরে। খরা, ঝড়, ধস, গরম হাওয়া, বন্যা, পাল্টে যাওয়া বৃষ্টিপাতের ধরন, শুকনো আবহাওয়া, ইত্যাদির জন্য জঙ্গলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, বাদুড়রা বেঘর হচ্ছে, বাসা বাঁধছে মানুষের কাছাকাছি। আবর্তিত হচ্ছে এই প্রক্রিয়া। আর হ্যাঁ, আমেরিকা ইবোলা প্রতিরোধে মার্কিন কংগ্রেসের বরাদ্দ করা ২৫২ মিলিয়ন ডলার প্রত্যাহার করে নেবে বলে জানিয়েছে! পুঁজি নৈর্ব্যক্তিক। প্রাণ তার কাছে ততটাই মূল্যবান, যতটা সে মুনাফা এনে দিতে পারে।

(চলবে)

সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ

তথ্যসুত্র: বিগ ফার্মস মেক বিগ ফ্লু, রব ওয়ালেস, মান্থলি রিভিউ প্রেস;

ক্যাচিং ব্রেথ: দ্য মেকিং অ্যান্ড আনমেকিং অব টিউবারকিউলোসিস, ক্যাথরিন লাফিড, ব্লুম্সবারি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন