আজও নারীর ক্ষমতায়ন সার্বিক স্তরে স্বীকৃত নয়। এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় মহিলা সংরক্ষণ বিলটির কথা।
মহিলাদের জন্য জাতীয় ও রাজ্য আইনসভায় ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য বিল আনা হয়েছিল। যদিও এ ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে: সম বিভাজন যদি হতেই হয়, তা হলে ৩৩ শতাংশ কেন, ৫০ শতাংশ কেন নয়? অবশ্য সে ক্ষেত্রে উল্টো দিকে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ দাবি করতে পারেন পুরুষেরাও, যুক্তির দিক দিয়েই। কিন্তু বড় আক্ষেপের কথা হল, ওই ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ বাস্তবায়িত করা গেল না আজও!
মূল সমস্যাটির শিকড় প্রোথিত সমাজের গভীরে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ব্যক্তি অধিকার লুণ্ঠিত। সব কিছুই যেন পুরুষের স্বার্থে তৈরি। এই সমাজে কিছু পুরুষোত্তম আমরা পেয়েছিলাম ঠিকই, যাঁদের তৎপরতায় নারীদের হারানো শিক্ষার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। শিক্ষার আলোয় নবজীবনপ্রাপ্ত নারীরা খুঁজে পেয়েছিলেন আত্মসত্তা। ‘আমরাও মানুষ’— এই বিশ্বাসে ঋজু হতে পেরেছিলেন। উনিশ শতকে দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগরণ নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। তার ফলে বেশ কিছু আত্মচেতনাময়ী নারীর উত্থান ঘটে সমাজে-সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নায়িকা কুমুদিনী বলেছেন— ‘‘এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না’’— বিশ শতকে সৃষ্ট এই নারী চরিত্রটির ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা আমাদের সামনে নারীর ব্যক্তিসত্তার এক চমকপ্রদ দিক খুলে দেয়। সন্তানের জন্যও নারী তাঁর আত্মমর্যাদাবোধকে হারাতে চান না— এর চেয়ে বড় নারীবাদ সত্যিই আর কী হতে পারে!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
উনিশ শতক থেকে বিশ শতক হয়ে আজ একুশ শতকেও নারীদের প্রতি এত অবহেলা কেন? বিশ্ব জুড়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালিত হয়। এই দিনটির পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। নারীদিবস মূলত নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই নির্দিষ্ট। পাশাপাশি, নারীজাতির প্রতি সমাজের সম্মান আদায়ও এর লক্ষ্য। এই দিনটির এই মর্যাদার পিছনে নারীদের দীর্ঘদিনের লড়াই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মান রাজনীতিবিদ তথা কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর, এর পিছনে রয়েছে শ্রমজীবী নারীদের প্রতি হয়ে চলা দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তিলাভের লড়াই। মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য তো ছিলই, তা ছাড়া মহিলাদের খাটতেও হত পুরুষদের চেয়ে বেশি সময়। এই-জাতীয় অমানবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পথে নেমেছিলেন সুতো কারখানার মহিলা শ্রমিকেরা। তাঁদের পথেই নিপীড়িত হতে হয়েছিল সরকারি লেঠেল বাহিনীর হাতে। সোভিয়েত রাশিয়ার নারীদের ভোটাধিকার ছিল না দীর্ঘদিন। আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরাও গণতান্ত্রিক অধিকার পান।
আমাদের দেশে নারীদের ভোটাধিকার থাকলেও নারী-পুরুষের সমমর্যাদার প্রশ্নে কিন্তু একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে নারী পুরুষ সমান বেতন পাচ্ছেন, এটা ঠিক। কিন্তু বাকি অনেক ক্ষেত্রেই সেটা হচ্ছে না। বিনোদনের দুনিয়ায় পুরুষের তুলনায় নারী বা স্পষ্ট করে বললে নায়কের তুলনায় নায়িকার পারিশ্রমিক কম। শুধু তা-ই নয়, মহিলাদের যৌন হয়রানি তো অতি মুখরোচক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বহুচর্চিত #মিটু আন্দোলন যৌন লাঞ্ছনার শিকার হওয়া মেয়েদের নিজস্ব লড়াই। তাঁদের মুখ খোলার সাহস জুগিয়েছে এই আন্দোলন। কিন্তু তাতেও কি অবমাননা কমছে?
সত্যি বলতে, আজও সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধেই আক্রান্ত সমস্ত ব্যবস্থা। তাই সব সময়ে মেয়েদের হেয় করার সংস্কৃতি বহমান। নারীজাতির এ হেন অবহেলায় সমাজ তথা রাষ্ট্রে প্রকৃত সুদিন আসা বাস্তবিকই অসম্ভব। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতেই হবে। তাই বিশেষভাবে জরুরি মহিলা সংরক্ষণ বিল প্রণয়ন। শুধু নারীর ক্ষমতায়নের জন্যই নয়, সার্বিক স্তরে নারীর অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতেই এই বিল বেশি প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সরকারি আমলা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রধান, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান হিসেবেও আমরা নারীদের পেয়েছি। অর্থাৎ ব্যক্তি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। কিন্তু সমষ্টির প্রশ্নে অঙ্কটা উল্টে যাচ্ছে। নারীজাতির প্রতি একটা অবজ্ঞার মনোভাব কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সংসারের মধ্যেও নারীর মতামতের প্রাধান্য কতটুকু!
রাহুল গাঁধী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কেন্দ্রে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মহিলা সংরক্ষণ বিল কার্যকরী করবেন। এতগুলি বছর আগে আনা হলেও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতের মিল না হওয়ায় বিলটি পাশ হয়নি। ২০১০ সালে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাশ হলেও, নিম্নকক্ষ লোকসভায় সেটি সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় আটকে যায়। বর্তমানে সংসদে এনডিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কেন পাশ হচ্ছে না বিল— এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সম্প্রতি সনিয়া গাঁধী লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিলটি দ্রুত পাশ করার জন্য সরব হয়েছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, বিজেপি-শাসিত হরিয়ানা বা রাজস্থানে ভোটে দাঁড়াতে ইচ্ছুক মহিলাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করায় তাঁরা ভোটে লড়তে পারছেন না। বিশেষ করে তফসিলি জাতিভুক্ত নারীরা তো একেবারেই শিক্ষার আলো পান না সেখানে। তাই মহিলাদের পক্ষে ভোটে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে মহিলারা পিছিয়ে পড়ছেন। সনিয়া তাই এই বিলটি এনে সংবিধান সংশোধনের দাবি জানান।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাখভি আশ্বাস দিয়েছেন, বিলটি চলতি অধিবেশনেই পেশ হবে। এইটুকুও যদি কার্যকরী হয়, নারীর ক্ষমতায়নকে তা আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে।
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শ্রীপৎ সিং কলেজ