ভেদ-যুগ 

বন্দে মাতরম্ গানটি লইয়া দ্বন্দ্ব ও অশান্তির ইতিহাস রীতিমতো সুদীর্ঘ— সেই ব্রিটিশ আমল হইতে চলিতেছে। কিন্তু তাহার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি বিশিষ্ট ভূমিকা অর্জন করিয়া লইলেন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share:

দ্বারভাঙার আরজেডি প্রার্থী আবদুল বারি সিদ্দিকি বিরোধিতা করেন বন্দে মাতরমের।

বন্দে মাতরম্ গানটি লইয়া দ্বন্দ্ব ও অশান্তির ইতিহাস রীতিমতো সুদীর্ঘ— সেই ব্রিটিশ আমল হইতে চলিতেছে। কিন্তু তাহার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি বিশিষ্ট ভূমিকা অর্জন করিয়া লইলেন। বলিলেন, জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়াইয়া যে প্রার্থী বন্দে মাতরম্ বলিতে অস্বীকার করিবেন, তাঁহার জামানত বাজেয়াপ্ত হইবে। প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মুখে বিপক্ষ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত করিবার কথা স্বভাবতই হুঙ্কারের মতো শোনায়, যাহা প্রথমেই আপত্তিকর। তাহা ছাড়া, এই গানটি লইয়া ভারতীয় নাগরিক সমাজের একাংশের অস্বস্তি ও আপত্তির কথা বহু কাল সুবিদিত হইবার পরও কেন প্রধানমন্ত্রীর উচ্চতায় দাঁড়াইয়া কোনও ব্যক্তি এমন কথা বলিবেন— সেই মর্মে আসিবে দ্বিতীয় আপত্তি। নরেন্দ্র মোদী অন্য সব রাজনীতি ছাড়িয়া বিভেদের রাজনীতি করেন, এই তথ্য প্রমাণের জন্য অতঃপর আর কি কোনও যুক্তি লাগে? দেশের প্রধান প্রশাসকের পদে আসীন থাকাকালীন তিনি বহু বার বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, তিনি কেবল সংখ্যাগুরু সমাজের নেতা, বাকিদের নেতা নহেন। শাসনের একেবারে শেষ প্রহরে, নির্বাচনের প্রচারেও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে সামনে টানিয়া আনিয়া তিনি সেই সত্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিলেন। সমাজের একাংশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অন্য অংশকে ‘লেলাইয়া’ দিতে চাহিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই তীব্র বিভেদকামী মন্তব্যের পরও যদি তেমন কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা না গিয়া থাকে, তবে একটিই কথা বলিবার থাকে: ভারতের নাগরিক সমাজ বোধ হয় তাহার প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষা অধিক সুবিবেচনাবোধ ধরে। মোদী হয়তো এই সমাজ হইতে কিছু শিক্ষা ধার লইতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর উক্তির প্রেক্ষাপট— টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্নের উত্তরে দ্বারভাঙার আরজেডি প্রার্থী আবদুল বারি সিদ্দিকির মন্তব্য যে, ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলিতে রাজি থাকিলেও ‘বন্দে মাতরম্’ বলিতে তাঁহার অসুবিধা, কেননা তাঁহার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এই উচ্চারণ। প্রার্থীকে কেন এই প্রশ্ন করা হইয়াছিল, তাহা লইয়াও ভ্রুকুঞ্চনের জায়গা থাকে, কেননা প্রায় শতাধিক বর্ষ যাবৎ ভারতীয় মুসলিমরা ‘বন্দে মাতরম্’ গানটিকে লইয়া আপত্তি পোষণ করিয়া আসিতেছেন। এই গানের বক্তব্য এক-ঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের পরিপন্থী বলিয়া তাঁহারা মনে করেন। বাৎসরিক কংগ্রেস অধিবেশনে এই গান গাহিবার ঐতিহ্য থাকিলেও ১৯৩৭ সালের অধিবেশনে স্থির হয়, সাংস্কৃতিক বিভেদের বিষয়টি মাথায় রাখিয়া কেবল গানের প্রথম স্তবকটি গাওয়া হইবে। জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ চাহিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে প্রথম স্তবকের পক্ষে মত দিলেও পরে বলিয়াছিলেন, এই গানটিকে বাদ দিয়াও কাজ চলিতে পারে।
বাস্তবিক, যে যুক্তিতে সিদ্দিকি সাহেব বন্দে মাতরম্ গাহিবার অক্ষমতার কথা বলেন, একই যুক্তিতে ভারতমাতার নামে স্লোগান তুলিতেও তিনি অসুবিধা বোধ করিতে পারিতেন। তাহা সত্ত্বেও যে নিজের বক্তব্যে তিনি ভারতমাতার নামে সম্মতিটি জুড়িয়া দিয়াছেন, তাহাতে অনুমান করা চলে, সাম্প্রতিক ভারতের সংখ্যালঘু-বিদ্বেষে কোণঠাসা বোধ করিয়াই হয়তো তাঁহার এই স্বীকৃতি। সংখ্যালঘুদের আরও খানিক ভয় দেখাইলে, হুমকি দিলে বাকিটাও তাহারা মানিয়া লইবে— নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দল নিশ্চয় এমনই ভাবে। যে হিন্দুত্ববাদীরা ভিন্ন সম্প্রদায়কে নিজেদের সংস্কার মানিয়া গোমাংস ত্যাগে বাধ্য করে, ভিন্ন সম্প্রদায়কে নিজেদের সংস্কার-অবলম্বী গান গাহিতেও যে তাহারা বাধ্য করিবে, তাহাতে বিস্ময়ের কী। বিস্ময় কেবল এইটুকুই যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীও নিজেকে দলের তথা সঙ্ঘের অসহিষ্ণু গোরক্ষক পান্ডাদের সমগোত্রেই ফেলিতে তৎপর। এই দলে লঘুগুরু উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন