গণশুদ্ধি ছাড়া গণতন্ত্র আসলে কাঁঠালের আমসত্ত্ব

গণতন্ত্রে গণ ও গণপ্রতিনিধি উভয়েই যত বেশি জানে, তত কম মানে। কারণ, শাসকের প্রশ্রয় থাকলে গণের দাবি না মেনেও দিব্যি পার পাওয়া যায়। কিন্তু কত দিন? লিখছেন সাহাবুদ্দিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৯ ০২:০৮
Share:

বহুদলীয় গণতন্ত্রের পবিত্র মন্দিরে যে দল থেকেই গণপ্রতিনিধির জয় হোক, অন্তত স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে এসে এ বার অন্তত এটুকু আমরা নিশ্চিত করার দায় নিই যে কোনও সমাজবিরোধী কিংবা সমাজবিরোধীকে প্রশ্রয় দেওয়া এমন কেউ আমাদের এই গণতন্ত্রে গণপ্রতিনিধি হবে না।

Advertisement

রাজনৈতিক মতাদর্শ, দলীয় ইস্তাহার ও সংশ্লিষ্ট ভোটপ্রার্থীর স্বচ্ছতার সাযুজ্যই তো গণকে ভোটমুখী করার মূল প্রণোদনা। দুৰ্ভাগ্য, এগুলির জায়গা নিচ্ছে দলীয় সন্ত্রাস ও লাগামছাড়া দুর্নীতি। একমাত্র গণের সচেতনতা, তৎপরতা ও সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিই পারে একে রুখে দিতে। ভোট কেন্দ্রের সামনে সব বাধা পেরিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো ভোটারের লম্বা লাইন দেখে সেই সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিকেই টের পাই। এটাই গণের ভরসার জায়গা।

ভোটপ্রার্থীর প্রথাগত শিক্ষা দেখে নেওয়ার কথা না হয় আপাতত ছেড়েই দিলাম। আকবর থেকে অশোক, রামকৃষ্ণ থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউ-ই প্রথাগত শিক্ষার ফসল নন। প্রথাগত শিক্ষার উপযোগিতা অস্বীকার না করেও বলছি, প্রকৃত শিক্ষা ঠিক কিসে হয়, তা নিয়েই যথেষ্ট বিতর্কের জায়গা আছে। বিশেষ করে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি জনগণের সেবার জন্য নির্বাচিত হতে চান। মাদার টেরিজা কিংবা বিবেবেকানন্দ যদি কোনও সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটপ্রার্থী হতেন তা হলে তাঁদের প্রথাগত শিক্ষা নিয়ে কি কোনও আহাম্মক প্রশ্ন তুলত? হয়তো এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমাদের সংবিধান জনপ্রতিনিধির প্রথাগত শিক্ষার দিকটা নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না।

Advertisement

কিন্তু তাই বলে ভাবমূর্তির স্বচ্ছতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দাগী সমাজবিরোধীকে মোটেও গণপ্রতিনিধির জায়গা করে দিতে বলে না। আর গণ নিজেও কি সব সময়ে স্বচ্ছ? নিজের কাছে স্বচ্ছ হওয়ার দায় নিলে তবেই তো অন্যের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার জন্মায়। “আপন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে সত্য করিয়া তোলা”র ব্রত পালনের কথা রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই বলে গিয়েছেন। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ধারক একশো তিরিশ কোটি গণ তার কতটুকু পালন করে তার রোজনামচায়? এক জন শিক্ষক যখন নিয়মানুবর্তী না হয়ে ছাত্রকে বলেন নিয়মানুবর্তী হতে, সেটা কতটা নিয়মকে সম্মান জানায়? কিংবা এক জন চিকিৎসক যখন ওটিতে রোগীকে শায়িত রেখে হতদরিদ্র রোগীর স্বজনের সঙ্গে পয়সা নিয়ে দর-কষাকষি করেন আর তাঁরই কর্তব্যের গাফিলতির খেসারত হয় রোগীর অকালমৃত্যু— তখন তাঁদের মুখে কি শাসকের সমালোচনা মানায়? নাকি এই সব গণ গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার ওষুধ হতে পারে? সব পেশাতেই যুক্ত এমন কোটি কোটি গণ “আপন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে সত্য করিয়া তোলা”র ব্রত হতে আলোকবর্ষ দূরে। মজার কথা, এমন স্ববিরোধী গণই হাটে, মাঠে-ঘাটে, বাজারে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ করছে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান দণ্ডনীয় জেনেও মুখে সিগারেট গুঁজে সুখটান মারতে মারতে ‘দেশটা রসাতলে গেল’ মার্কা স্তোকবাক্য ঝাড়ছে। ব্যাপারটা যেন চেন স্মোকার চিকিৎসক হাঁপানির রোগীর সামনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শোনাচ্ছেন বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ---- ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর! হাস্যকর! গণের এই স্ববিরোধী কীর্তির লম্বা লিস্টি কি শেষ হওয়ার? যে গণ শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে সরব, সেই গণই কর্মক্ষেত্রে নিজের অধস্তনকে অকারণে নিগ্রহে নিঃসঙ্কোচ। অধঃস্তনের সামান্য বিচ্যুতিতে যিনি এক কোপে পারলে দু’কোপে যান না, তাঁর নিজের গগনচুম্বী বিচ্যুতির হিসেব কে রাখে? বাড়ির বাসন মাজার মাসিমা থেকে অফিসের ঝাড়ুদার হয়ে দারোয়ান পর্যন্ত সমস্ত অধঃস্তনের সঙ্গে শাসক-শাসিতের স্বেচ্ছাচারী পারাডাইম তরিতে গণ সিদ্ধহস্ত।

সর্বোপরি, যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বেলাগাম দুর্নীতি ও সার্বিক স্খলন নিয়ে গণের এত মাথাব্যথা, তাদেরকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগটা কে করে দিচ্ছে? করে দিচ্ছে সেই গণ, যে কিনা নিজের একমাত্র হেলথ ড্রিংক খাওয়া আদরের সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর খোয়াবে প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানোর স্বপ্নে বিভোর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে যথার্থ রাষ্ট্রনীতিক বা রাষ্ট্রের সেবক বানাতে চান কত জন গণ? এই গণকে কী বলবেন? নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধকারী এই সুযোগসন্ধানী গণকে বলবেন বেচারি গণ, না কি সাবাস গণ?

আর আমি বা আপনি কোন ক্যাটাগরিতে পড়ি, তা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। যে ক্যাটাগরিতেই পড়ি না কেন নির্মম সত্য এটাই, গণের এই অন্তর্লীন স্ববিরোধ গণতন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাইরাস। আর স্ববিরোধে দীর্ণ এই সাবাস গণের সঙ্গে আপন কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান নিরীহ গণের সহাবস্থান গণতন্ত্রের বিষফোঁড়া। আশার কথা, এই বিষফোঁড়া ও ভাইরাস ক্ষতিকর হলেও দুরারোগ্য নয়। একমাত্র গণ নিজেই পারে এর চিকিৎসা করতে, গণের নিজের হাতেই আছে এর প্রতিষেধক। আর সে প্রতিষেধকেই গণতন্ত্রের গণশুদ্ধি।

তাই আমরা কোটি কোটি গণ এ বার নিজের ভোটটি নিজে দেওয়ার আগে নিজের শুদ্ধি ও স্বচ্ছতার অধিকারে ভোটপ্রার্থীকে, নিছক ভোটপ্রার্থী নয়, একটু মানুষ হিসেবে বিচারের দায়টুকু যদি পালন করতে পারি, তা হলে প্রতীকের সঙ্গে ভোটপ্রার্থীর ভাবমূর্তির স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এক দিন বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দল। অবশ্যই তা এক দিনে হবে না। কিন্তু গণের এই দীর্ঘমেয়াদি গণতৎপরতা এক দিন সফল হবে বলেই বিশ্বাস। দূর হবে দলীয় প্রতীক আর দলীয় ভোটপ্রার্থীর বিশ্বাসযোগ্যতার চিরায়ত প্যারাডক্স।

এই বিশ্বাস, এই আশা নিয়েই বলি— হে আমার গণ, এ বারের নির্বাচনে অন্তত এই কাজটুকু পবিত্র দায় ভেবে পালন করে দেখিয়ে দাও। কারণ, এটাই গণতন্ত্রে গণশুদ্ধির প্রথম ধাপ। আর এই গণশুদ্ধিই গণতন্ত্রের অন্তর্লীন শক্তি, গণমুক্তির পথ। এ পথ আত্মসমীক্ষার সহজিয়া পথ, যা কারওর মুখাপেক্ষী না হয়ে গণ নিজেই নিজের মধ্যে খুঁজে পেতে পারে। আর এ পথের সন্ধান শুধু জরুরি নয়, আবশ্যক। গণশুদ্ধি ছাড়া গণতন্ত্র আসলে যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব। (শেষ)

লেখক শক্তিনগর উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন