‘বফর্স’ শব্দটিই কিন্তু একটি নির্বাচনের ফল নির্ণয় করেছিল

২০১৯-এর যুদ্ধে রাম বনাম রাফাল

রামলালা নিয়ে এই ক্লিশে হয়ে যাওয়া রাজনীতির মোকাবিলায় রাহুলের ব্রহ্মাস্ত্র রাফাল। তূণের শ্রেষ্ঠ বাণ যে এইটি, তা ক্রমশ সমগ্র ভূভারতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অতএব ২০১৯-এর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ রাম বনাম রাফালের।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৮
Share:

নির্বাচনী: অযোধ্যায় রাম মন্দিরের দাবিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘হুঙ্কার সভা’য় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। নাগপুর, ২৫ নভেম্বর। পিটিআই

শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় কণ্বমুনি বুঝেছিলেন, স্নেহ অতি বিষম বস্তু। কথাটি একটু বদলে বলতে ইচ্ছে করছে, আসলে আবেগই এক বিষম বস্তু। বিশেষত আমাদের দেশে ভোটের সময় রাজনৈতিক আবেগ যে কত ভয়াবহ হতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বার বার। তা সে রাম মন্দিরই হোক আর বফর্স। ভোট যুদ্ধে বুদ্ধি-যুক্তির উপর আবেগই শাসন করে এই ধারণাকে পূর্বসিদ্ধ ধরে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ আবার চিৎকার করে বলতে চাইছেন, জয় শ্রীরাম। মন্দির ওখানেই হবে। আমরা মন্দির না বানালে আর কে বানাবে? রাহুল গাঁধী? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।

Advertisement

রামলালা নিয়ে এই ক্লিশে হয়ে যাওয়া রাজনীতির মোকাবিলায় রাহুলের ব্রহ্মাস্ত্র রাফাল। তূণের শ্রেষ্ঠ বাণ যে এইটি, তা ক্রমশ সমগ্র ভূভারতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অতএব ২০১৯-এর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ রাম বনাম রাফালের।

বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক যখনই ক্ষয়রোগের শিকার হয় তখনই সঙ্ঘ পরিবার ফিরে আসে রাম মন্দিরে। গত পাঁচ বছরে সুবক্তা কুশলী রাজনেতা দেশের প্রধানমন্ত্রী কত বার কত ভাবে বললেন, ‘বিকাশ- বিকাশ’— কিন্তু এখন সব সুর ভুলে হারমোনিয়ামে রাম মন্দির আর হিন্দুত্বের সা–পা’র সাদাকালো রিড টিপে ধরে বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট যা-ই বলুক, আইন হবে, বিষয়টি বিশ্বাসের, বিচারালয়ের নয়। অতএব লালকৃষ্ণ আডবাণী রাম জন্মভূমি আন্দোলনের যে পথ দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, এ বার তারই এক নতুন অধ্যায়। পুরনো বোতলে নতুন, না কি পুরনো সুরাই পরিবেশন?

Advertisement

এক বন্ধু একদা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘শোলে’ এক বারই হয়।’’ ১৯৭৫ সালে, জরুরি অবস্থার সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শোলে’ ছিল সুপারডুপার হিট ছবি। তার পর শোলের কায়দায় অনেক ছবি হয়েছে। কিন্তু ফর্মুলা যা-ই হোক, ‘বার্নিং ট্রেন’ বা ‘চায়না গেট’ হয়েছে, শোলে আর হয়নি। বিজেপির এক নেতাই সে দিন বলছিলেন, ১৯৮৯ নির্বাচন থেকে ভারতের রাজনীতিতে এক দীর্ঘ সময় ধরে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে রাম মন্দির আন্দোলনের পটভূমিতে। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দু এবং মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি কম হয়নি। কিন্তু পুরনো টিনের ট্রাঙ্ক থেকে পোকায় কাটা আলখাল্লা আর উকুন ভরা নকল দাড়িগোঁফ, উইয়ে কাটা রাংতার তরবারি নিয়ে ফের কুরুক্ষেত্রে নেমে লাভ হবে?

হে পাঠক! আমায় ক্ষমা করবেন। সাংবাদিক হিসেবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের রাজনীতি কভার করে আমি এ প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এ দিতে অক্ষম। এ ভাবে এ প্রশ্নের জবাব দিলে আমার স্বস্তি হবে যে এখনও পর্যন্ত এ দেশের শহরে বা গ্রামে রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে কোনও শোরগোল দেখছি না। কর্মী ও আমজনতাও বুঝছে এ হল ভেকধারী রাজনীতি। কিছু দিন আগে বেনারস গিয়েছিলাম। বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়ার পথে গাড়ির চালক গিরীশ চন্দ্র পান্ডে বলেছিলেন, ‘‘আমরা পারিবারিক ভাবে বিজেপি সমর্থক। কিন্তু আপনি পত্রকার, আপনাকে একটা কথা বলি, যখনই ভোট আসে তখনই কেন নেতাদের রামমন্দিরের কথা মনে পড়ে? বাজপেয়ীজির না হয় সংখ্যা ছিল না। কিন্তু পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে একার জোরে, তা হলে তুমি কেন এত দিন আইন করোনি?’’ গিরীশ চন্দ্রের বয়স আনুমানিক ষাট। বেনারসের ব্রাহ্মণ সন্তান। উনিই গাড়ির মালিক। তিন-চারটে গাড়ি খাটছে ওঁর। বাবাও ড্রাইভার ছিলেন। গাড়িতে বাবা বিশ্বনাথের ছবি। গাঁদাফুলের মালা। ফুরিয়ে যাওয়া ধূপের সুবাস।

আপনারা আমাকে এখানে থামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, এটাই যদি ‘মুড অব দ্য নেশন’ হয় তবে কেন বলছেন জবাব দিতে অক্ষম? আবার বলছি, এর পরও জানি না শেষ পর্যন্ত ২০১৯-এ হিন্দি বলয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ভোটারের আচরণকে শেষ বেলায় নিয়ন্ত্রণ করবে কি না। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত নেতা অশোক ঘোষের একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। উনি বলেছিলেন, ঝড় অস্থায়ী। বহমান বাতাস চিরস্থায়ী। কিন্তু অস্থায়ী ধুলোঝড়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও আমরা অন্ধ হয়ে যাই।

রাহুল গাঁধী এই কুসংস্কারের রাজনীতির প্রতিবাদে যে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে চলেছেন সেটি রাফাল। রাহুলকে প্রথমে বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে বলতেন ‘পাপ্পু’, যেমন ইন্দিরাকে একদা মোরারজি দেশাইরা বলেছিলেন ‘গুঙ্গী গুড়িয়া’। এখন সেই বিজেপি নেতারাই রাহুলকে আর পাপ্পু বলছেন না বরং স্বীকার করছেন, রাহুল পরিণত। হতে পারে রাহুল মোদীর মতো সুবক্তা নন। হতে পারে রাহুলের কোনও অমিত শাহ নেই। যিনি মতাদর্শ ভুলে শুধুই ভোটে জেতার কৌশল করে যাবেন ছলেবলেকৌশলে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে বিজেপি নেতারাও অনেকে একান্ত আলোচনায় আমাকে বলেছেন, প্রথমে মনে হয়েছিল, রাফাল দেশের লোকে খাচ্ছে না। শুধুই শহরের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, বামপন্থী উদারবাদী ডিবেটিং সোসাইটি গলার শিরা ফুলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে চিৎকার করছেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে তা নয়। হিন্দি বলয়ের গ্রামেগঞ্জেও মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করছে রাফাল চুক্তিতে কিছু লোক টাকা খেয়েছে। রাঘব বোয়ালেরা। এক বিজেপি কর্মী দিল্লি এসেছিলেন। বহু দিনের পরিচিত। তাঁর সঙ্গে দেখা হল নিতিন গডকড়ীর অফিসে। তা সেই যুবনেতাটি বললেন, আমাদের ধান্দাপানি বন্ধ হলেও বড় বড় ‘হস‌্‌তি’দের কি টাকার খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে? বেনারসের রামকৃষ্ণ মিশনে এক প্রবীণ মানুষ খুব মোদীভক্ত ছিলেন। তিনি বললেন, রাফালে কত কোটি টাকা খেয়ে এখন রোজ ন্যায়নীতি আর উন্নয়নের জ্ঞান দিচ্ছেন?

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। আবেগ সত্যই বড় বিষম বস্তু। দেখুন, বফর্স অস্ত্র চুক্তিতে আজও প্রমাণ হল না রাজীব গাঁধী ঘুষ খেয়েছেন। বরং প্রমাণের অভাবে তদন্তই বন্ধ করে দেয় আদালত। অথচ এ দেশে একটা লোকসভা নির্বাচন শুধু বফর্স নামক একটি শব্দেই হয়ে গিয়েছিল। রাফাল নিয়ে বেশ কিছু আঞ্চলিক নেতা–নেত্রী বিস্ময়কর ভাবে নীরব। তাঁরা কেন নীরব জানি না, কিন্তু দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে এই ধারণা যে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এ-ও এক রাজনৈতিক আবেগ।

আবেগেরও আর্থ-সামাজিক বস্তুগত পটভূমি থাকে। চূড়ান্ত আর্থিক দৈন্য। চাকরিবাকরি নেই। কৃষকরা আত্মহত্যা করছে। দেশ জুড়ে কৃষিজীবীদের প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। এই পটভূমিতে বিজেপি যেমন মানুষের ধর্মীয় সংস্কার–কুসংস্কারের আবেগে সুড়সুড়ি দিতে চাইছে ঠিক তেমন রাহুলের রাফাল কিন্তু শুধু রাফাল নয়, এ-ও এক আবেগ। এ আবেগেও দেশপ্রেম আছে, কারণ এ হল প্রতিরক্ষার বিষয়, দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। এ আবেগের সঙ্গে দৈনন্দিন রুটিরুজির হতাশা আছে, আমি গরিব গরিবই থাকছি আর তুমি মহারাজা উৎকোচে পিছলে যাচ্ছ? এ-ও এক আবেগ।

শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না, আপাতত বলব কুরুক্ষেত্র প্রস্তুত। যুদ্ধ রাম বনাম রাফালের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন