দীর্ঘ ঔদাসীন্য নির্মাণ করে হিংসা, যা চোখে দেখা যায় না
তেত্রিশ বছর কথা রাখা হয়নি, কিন্তু চৌত্রিশ বছরে এসে তো হল। ভারতীয় আইন-আদালত তো রায় দিয়ে দেখাল ১৯৮৪-র শিখ দাঙ্গার বিরুদ্ধে। তৎকালীন সাংসদ সজ্জন কুমারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল তো! ভরসা হারাতে নেই কখনও। আইনের হাত ৩৩ বছরের চেয়েও লম্বা!
কিন্তু এটা ঠিক কী হল? ন্যায়? মনের ভিতরে তলিয়ে দেখলে এই রায়কে কি ন্যায় বলা চলে? বরং এটাকে বড়জোর একটা দীর্ঘ অন্যায়ের পরিসমাপ্তি বলা যেতে পারে। আর যাঁরা এই পরিসমাপ্তি ঘটানোর সৈনিক, তাঁদের অপর্যাপ্ত কুর্নিশ করতে মন চায়। যেমন আইনজীবী হরবিন্দর সিংহ ফুলকা, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে যিনি শিখ-নিধনের সময় বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটের লফটে ঢুকে বসেছিলেন। পাক্কা দুটো দিন। তবে বাঁচতে পেরেছেন। এবং তার পরে প্রতিটি মুহূর্ত লড়েছেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন, নানাবতী কমিশন, আরও অন্তত ১১টা তদন্ত কমিটির সামনে প্রতি দিন, প্রত্যেক সেকেন্ড লড়েছেন। সাংসদ পদ ছেড়ে দিয়েছেন কেবল এই লড়াইটা ঠিক ভাবে করতে পারবেন না বলে। আজ থেকে ঠিক ন’বছর আগে, যখন ওঁর চেম্বারে বসে ওঁর মুখে নিজের, পরিজনদের ও শিখ সম্প্রদায়ের সেই যন্ত্রণার বিবরণের কথা শুনছিলাম, তখন ওঁর চোখে রাগের অগ্নিবলয়, সরকারের দীর্ঘ ঔদাসীন্যের প্রতি ঘৃণা আর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা— সবটা এক সঙ্গে ফুটে উঠেছিল।
২০০৯-এ, শিখ-হত্যার দোষীরা যখন শাস্তি পায়নি, তখন সাংবাদিক সম্মেলনে পি চিদম্বরমের দিকে জুতো ছুড়েছিলেন এক শিখ সাংবাদিক। জার্নেল সিংহ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডেটলাইন ২৪ অক্টোবর, ২০০৯। লাজপত নগর, নিউ দিল্লি। জার্নেল সিংহের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। হেঁহেঁ আমি অমুক... কলকাতা থেকে... হ্যাঁ হ্যাঁ...আসলে আমি কাল রাতেই দিল্লি ফিরেছি... ইত্যাদি শেষ হতেই সোজাসুজি জুতো ছোড়া প্রসঙ্গে। নম্র, ভদ্র মধ্য ত্রিশের মানুষটি শান্ত গলায় জানিয়ে দিলেন— মেনে নিতে পারিনি, ২৫ বছর পরে ১৯৮৪’র অ্যান্টি শিখ রায়টের দোষীদের শাস্তি হল না। গোটাগুটি পঁচিশটা বছর অপেক্ষা করেও ১৯৮৪’তে কেবল সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৩০০০ শিখ নিধনের কোনও সুবিচার তো হলই না, উল্টে যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা সবাই ভাল ভাল পোস্ট পেল, ভাবতে পারেন? আমার দাদার একটা পায়ে পোলিয়ো ছিল, দাদা ওর তিনচাকা গাড়িতে যাচ্ছিল, ওরা ছাড়েনি। ওরা দাদাকে পিটিয়েছিল, বাবাকে জখম করেছিল। আমাদের সম্প্রদায়ের কত মানুষ কেন বিনা অপরাধে মারা গেল বলুন তো? আর, যে দিন ইন্দিরাজি মারা গেলেন তার চব্বিশ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর কেন ওই হত্যা শুরু হল? যদি লোকের এতই রাগ, তা হলে চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করল কেন? আর কেনই বা তিন দিন পরে হঠাৎ সব থেমে গেল? সব শান্ত হয়ে গেল? আর ঘর থেকে আমাদের রাস্তায় টেনে বার করে, খামকা ঘর-বাড়ি-স্কুটার-মানুষদের সব জ্বালিয়ে দিল? আর এত বছরে এতগুলো সরকার বদল হল, কারও মনে হল না আমাদের সঙ্গে আমাদের দুঃখ ভাগ করে নেয়? সেই এক জন শিখ প্রধানমন্ত্রী আসার পরই কেন ক্ষমা চাইতে হল? এই যে অবহেলা, গড়িমসি, ভোটব্যাঙ্কের চাপানউতোর, এই দিয়ে পেরিয়ে গেল পঁচিশটা বছর, এতগুলো জীবন, এতগুলো পরিবার বরবাদ হয়ে গেল, তার দাম কে দেবে? ক্ষতিপূরণ কি সব যন্ত্রণা ধুয়ে দিতে পারে? আমি জুতো ছুড়েছিলাম, ঠিকই, কিন্তু চিদম্বরমকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, ওটা ছিল প্রতীকী প্রতিবাদ।— জার্নেল সিংহ পরে একটা বইও লিখেছেন এই বিষয়ে: আই অ্যাকিউজ়। তিনি হয়তো এই রায় শুনে কিছুটা শান্তি পেলেন।
এই রায় শুনে কেমন লাগছে সুরিন্দর কউর-এর, যাঁর বাবাকে মাথায় রড মেরে অজ্ঞান করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর তার পর তাঁরা কখনও তাঁদের বাবাকে দেখেননি? শহিদগঞ্জ গুরুদ্বারের জগদীশ সিংহেরই বা কেমন লাগছে, যাঁর বাবাকে আর দাদাকে এক সঙ্গে চুলে গিঁট বেঁধে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল?
সত্যি কি ৩৪ বছর পর কোনও অন্যায়ের শাস্তি হলে, সেই ন্যায়ের তীব্রতা একই রকম থাকে?
আচ্ছা, সজ্জন কুমারের বয়স তখন কত ছিল? এখন ৭৩ হলে, তিনি তখন মোটামুটি ৩৯ বছর বয়সি এক যুবা। ৩৪ বছর তিনি দিব্যি সংসারধর্ম, পার্টি-রাজনীতি, সুবিধাভোগ সবই করে নিয়েছেন। জীবনের শেষ বেলায় এসে তাঁকে কষ্ট করতে হবে। কিন্তু তখন যাঁদের সাত, দশ, বাইশ, সতেরো, আটাশ, উনচল্লিশ বয়স ছিল, তাঁদের জীবনটা তো ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যাঁদের আর কোনও সহায়সম্বল ছিল না, সরকারি ক্যাম্পে গিয়ে উঠতে হয়েছিল তাঁদের। মাঝের এই ৩৪ বছর তাঁদের কেমন কেটেছে?
১৯৯৯ সালে দিল্লির তিলক বিহার বিধবা-কলোনিতে গিয়ে তাঁদের অনেকের জীবন স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কথা বলেছিলাম অনেকের সঙ্গে। বাচ্চারা ভাল স্কুলে যায়নি, অনেকে স্কুলেই যায়নি, বাড়ির বৌদের হঠাৎ কর্মজীবন শুরু করতে হল সংসার চালানোর জন্য, বাচ্চারা মা’দের পেল না, পরিজন পেল না, শিক্ষা পেল না, স্বাস্থ্য পেল না, চাকরি পেল না, বাবার মোটর-পার্টসের দোকান পেল না, বাবা-ভাইদের নিয়ে পরিবার পেল না, সমাজে সম্মান পেল না। কী কী পেল? বঞ্চনা পেল, দারিদ্র পেল, অসম্মান পেল, ড্রাগ পেল, অসভ্যতা পেল, অভদ্রতা পেল। হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ হয়তো পেল। যা কিছু কালের মধ্যে ফুরিয়ে গেল। অনেক কালের জন্য পেল একটা দিশাহীন, মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, দয়ার বা ঘেন্নার ভবিষ্যৎ।
আর তাই প্রশ্ন ওঠে, এত বছর পর এই ন্যায়দণ্ডের দৌলতে এ সবের কিছু কি ফেরত পেল এরা? জীবনের এতগুলো বছর, এত বঞ্চনা, এত কষ্টের প্রতিকার পেল কি? না কি, এ খবর শুনে সাতষট্টি বছরের বৃদ্ধাকে কালও কলোনির মোড়ের মাথার কলে জল তুলতে হবে না? কাল ছেলেপুলেরা ড্রাগ খাবে না? কাল থেকে চমৎকার সব খাবার মিলবে, কাল থেকে কাচের দরজা খুলে অফিস ঢুকে যাবে বিধবা কলোনির ছেলেরা বা নাতিরা? কে বলতে পারে, এ ঘটনার দায়ভার এক প্রজন্ম, না কি দুই প্রজন্ম বহন করছে?
আর আমি? আমি কী পেলাম? অবাক করা প্রশ্ন, তাই তো? কিন্তু আমি তো জন্ম থেকে বড় হয়েছিলাম একটা শিখ পরিবারের সঙ্গে। আমাদের কোনও বাড়ির দরজা বন্ধ হত না কখনও। বাইরের লোক বুঝতে পারত না আমরা ক’ ভাইবোন। পুজোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়া আর প্রায় রবিবার আমার গুরুদ্বারে যাওয়ায় কোনও তফাত বুঝিনি। ১৯৮৪’র ঘটনার পর ওদের আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবুও ওরা সব বন্ধন ছিন্ন করে পঞ্জাব চলে গিয়েছিল। আমাদের দুই বাড়ির হাওয়া আর একে অন্যকে কেটে বেরিয়ে যায়নি। মুখোমুখি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বছর দুই পরে যখন ওরা ফের ফিরে এল, তখন আর আয়না-ভাঙার দাগটা গেল না। দুই পরিবার অটুট থাকল। কিন্তু কোথায় যেন শিখ আর হিন্দু, এই অনুচ্চারিত শব্দ দুটো প্রেতের মতো ঘুরতে থাকল। আমি তো আজ প্রশ্ন করতেই পারি, আমি কেন হারালাম আমার কিশোরীবেলার বিশ্বাস, বন্ধুত্বের এসেন্স, তড়কা ডাল আর রুটির মহাভোজ, খাটিয়ায় অকাতর ঘুমিয়ে পড়া?
আসলে, আদালত শেষ পর্যন্ত দণ্ডাদেশ দিয়ে একটা খুব বড় কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু এমন একটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে কাউকে এই ভয়ানক অপরাধের শাস্তি দিলে, ন্যায়ের বোধটা সম্পূর্ণ হয় না। কারণ দীর্ঘ ঔদাসীন্য নির্মাণ করে হিংসা, বৃহত্তর হিংসা, যা তেমন করে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এক ধারাবাহিক যন্ত্রণার চেহারা নিয়ে, ঠিক যেমনটা হয়ে চলেছে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষজন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর দিয়ে, তাঁদের প্রতি ঔদাসীন্যের জন্য যে যন্ত্রণা তাঁরা ভোগ করে চলেছেন সেটা হিংসা নয়? আর, আক্রান্ত শিখদের পরিবারবর্গ যে বঞ্চনা বছরের পর বছর সয়ে চলেছেন, সেটা হিংসা নয়?
আরও এক বার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, রাজধর্মের প্রধান এক অঙ্গ প্রজাদের যত্ন করা, সেই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে রাষ্ট্র, বারংবার। বহু বছর ধরে মুখ ফিরিয়ে থাকা হয়েছে এই সব নিপীড়িতের প্রতি। এক সময় এই অযত্ন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আর অভ্যেসের অযত্ন জন্ম দিয়েছে হিংসার। ক্ষতের যত্ন না নিলে ক্ষত বাড়বে, এ কথা সবাই জানে। কিন্তু যত্ন না নিতে নিতে এক সময় ক্ষতের তীব্রতা অন্যের মনকে আর ক্ষতবিক্ষত করবে না। এই অবধারিত ঔদাসীন্য থেকেই জন্ম নেয় নীরব, শীতল, তীব্র হিংসা। আমি শরণাগতকে আশ্রয় দিলাম না, বরং শরণাগতকে যতটা সম্ভব উপেক্ষা করে তাকে ভয়ানক একটা জীবন বাঁচতে বাধ্য করলাম। প্রথমে তার সুস্থ জীবনটা কেড়ে নিলাম এবং তার পর আমার সুপরিকল্পিত অবহেলা তাকে দান করলাম, বলা ভাল, তাকে একটা অত্যন্ত খারাপ জীবন বেছে নিতে বাধ্য করলাম। আমার অযত্নের মনোযোগী অনুশীলন দায়িত্ববোধের দায়ভার থেকে মুক্ত করল আমায়। রাষ্ট্র ঠিক সেটাই করে চলল, এত বছর। তার পর এই দণ্ডাজ্ঞা। এ কি সত্যিকারের প্রাপ্তি? না কি একটা সান্ত্বনামাত্র?