ছুটি! ছুটি!

বর্তমান জমানায় সংবৎসরই পূজার মরসুম, উৎসবের কাল। সুতরাং ছুটি সত্য, কাজ মিথ্যা। বাঙালির মনস্কামনা ষোলো আনা পূর্ণ হইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় হাল্লার রাজা ছুটি পাইয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১৬
Share:

মহাকরণ। ফাইস চিত্র। w

হাল্লার রাজা ছুটির কাঙাল ছিলেন। কী অপার ক্লান্তিতে তিনি বলিয়াছিলেন: ‘‘আমার ছুটি হবে না?’’ সেই করুণ মুখখানি কোটি মন্বন্তরেও ভুলিবার নহে। ভূতের রাজার বরে ধন্য গুপী-বাঘার কল্যাণে শেষ অবধি তাঁহার আনন্দময় ছুটি হইয়াছিল। বাঙালিও ছুটির কাঙাল। কিন্তু তাহার নাগালে ভূতের রাজা নাই। ভূতের রাজার প্রয়োজনও নাই। ছুটি বাঙালির ছপ্পর ফুঁড়িয়া পড়িতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অবধি মুখ্যমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন, বাঙালির ছুটি-ভাগ্য তখন হইতে দুকূলপ্লাবী। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘ভূতের মতো’ খাটিবার কথা বলিয়া থাকেন। সে কথা অসত্য মনে করিবার কোনও কারণ নাই— তাঁহার পরিশ্রম করিবার ক্ষমতা অবিসংবাদিত। ইহাও সত্য যে, তিনি ধর্মঘট-হরতাল-বন্‌ধের নামে কাজ না করিবার বামপন্থী রোগ প্রশমিত করিয়াছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, সেই বাস্তববোধ ছুটির ক্ষেত্রে প্রসারিত হয় নাই। এমনিতেই বাঙালির জীবনে ছুটি বেশি। তাহা কমানো আবশ্যক। মমতাদেবীর রাজত্বে ঘটিয়াছে তাহার বিপরীত। রাজ্যবাসীকে, বিশেষত সরকারি কর্মীদের ছুটি দিবার ব্যাপারে তাঁহার বদান্যতা ভূভারতে অ-তুলনীয়। মাত্র কয় বৎসরে কত ছুটি যে তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন, এবং আরও কত ছুটি যে তাঁহার স্পর্শের অপেক্ষায় পাষাণ-রূপিণী অহল্যার ন্যায় কাল গনিতেছে তাহার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু এই শ্রীপঞ্চমীতে তিনি নিজেকেও অতিক্রম করিয়া নূতন কীর্তি স্থাপন করিলেন। সরস্বতী পূজা রবিবারে (মতান্তরে শনিবারে) পড়িবার ফলে ছুটি ‘মার’ গিয়াছিল। রাজ্য সরকার সোমবার বাড়তি ছুটি ঘোষণা করিয়া সেই ক্ষতি পূরণ করিয়া দিয়াছে। এহ বাহ্য। এই উপলক্ষেই ঘোষিত হইয়াছে নূতন ‘নীতি’: যে সব পূজায় সরকারি ছুটির বিধান আছে (তালিকাটি, বাঙালি জানে, সতত বর্ধমান), সেগুলির নির্ঘণ্ট শনি বা রবিবারে পড়িলেই সেই ক্ষতি অন্য দিন পূরণ করা হইবে। ক্যালেন্ডার যাহাই বলুক, ছুটির মার নাই। এই ছুটি গ্যারান্টি প্রকল্পের প্রতি বাঁকা চোখে চাহিয়া দুষ্ট লোকে বলিতে পারে: রাখেন দিদি, মারে কে?

Advertisement

দুষ্ট লোকের কথায় কান দিতে নাই। বাঙালি এই অভাবিত ছুটির নিমন্ত্রণে পরম আহ্লাদিত হইবে, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারে না। বাঙালি ছুটির ভক্ত, তাহার সহজ এবং সরল কারণ: বাঙালি কাজ করিতে চাহে না। রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ উদ্ধৃত করিয়া এক সুরসিক নাগরিক বলিয়াছিলেন, কবি তাঁহার স্বাভাবিক ভদ্রতাবশত পরের লাইনটি লিখেন নাই: ‘আমরা করি না’। এই আলস্যের উৎস কী, তাহা সমাজবিদদের গবেষণার বিষয় হইতে পারে। সুজলা সুফলা প্রকৃতির আশীর্বাদ, নিরাপদ চাকুরির ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, প্রগতিশীল প্রতিবাদের নামে কথায় কথায় কাজ বন্ধ করিবার বামপন্থী ও সর্বজনস্বীকৃত ঐতিহ্য এবং/অথবা অন্য কোনও গূঢ়তর সত্য— কারণ যাহাই হউক, ঘটনা ইহাই যে, বাংলার জলহাওয়ায় কাজ ভুলাইবার রোগজীবাণু সতত প্রবল। শারদীয় মরসুমে তাহা বরাবরই প্রবলতর হইয়া থাকে, পূজার ছুটির রেশ বাঙালির আর ভাঙিতে চাহে না। কিন্তু বর্তমান জমানায় সংবৎসরই পূজার মরসুম, উৎসবের কাল। সুতরাং ছুটি সত্য, কাজ মিথ্যা। বাঙালির মনস্কামনা ষোলো আনা পূর্ণ হইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় হাল্লার রাজা ছুটি পাইয়াছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন