বেশ কয়েক দিন কেটে গেল, এখনও যেন উৎসব চলছে। প্রধানমন্ত্রী রাজস্থানে জনসভা করতে গিয়ে মুচকি হেসে বলেছেন, ‘‘কী, আজকে যেন আপনাদের একটু বেশি খুশি খুশি লাগছে?’’ সে দিন সরকারি অফিসভবনের দশতলা থেকে লিফটে নামতে নামতে হঠাৎ শুনি আমার অধোগমনের সঙ্গী অচেনা যুবকটি মুঠোফোনটি বাগিয়ে ধরে পরিতৃপ্ত ভাবে বলছেন তাঁর বন্ধুকে, ‘‘সন্ধেবেলা চলে আয় বাড়িতে, স্যাম্পেন (হ্যাঁ, তিনি স্যাম্পেনই বললেন) খাওয়াব। অনেক দিন ধরে সহ্য করেছি, আজ খুব খুশি লাগছে, পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেওয়া গিয়েছে।’’ দৈনন্দিনতার গ্লানি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে হঠাৎ-পাওয়া জয়ের বজ্রনির্ঘোষ। ঘরের কাছের দুই বাঙালি শহিদের এক জনের বাবা বিবৃতি দিয়েছেন, আজ সন্তান হারানোর দুঃখের মধ্যেও একটু আনন্দের রেশ— প্রতিশোধ নেওয়া গিয়েছে। বলেছেন, আরও পুত্রসন্তান থাকলে তাকেও পাঠাতেন সীমান্তরক্ষার কাজে, যাতে সে পাকিস্তানি আক্রমণের যোগ্য জবাব দিতে পারে।
পাশাপাশি অবশ্য পড়ি, শহিদের মা ভাগ নিতে পারেননি এই প্রতিশোধের আনন্দযজ্ঞে, পুত্রশোকে তিনি পাথর, জানেন যতই বদলা নেওয়ার দামামা বাজুক, তাঁর ছেলেটি আর ঘরে ফিরবে না। যেমন জানেন শহিদ বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতাও, তিনি বলেছেন প্রত্যাঘাতে কোনও লাভ হয় না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর অসীম শক্তি নিয়ে এমন যুদ্ধবিরোধী কথা বলার ‘অপরাধ’-এ সোশ্যাল মিডিয়ার দেশপ্রেমিকরা নির্দ্বিধায় তাঁর গায়ে দেগে দিয়েছে ‘দেশদ্রোহী’র তকমা। খবরে এ-ও পড়ছি, সাম্প্রতিক যুদ্ধোন্মাদনার প্রতিবাদে লাহৌরের নাগরিক সমাজ যুদ্ধবিরোধী মিছিল করেছে, সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন সেখানকার মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী ও শিল্পীরা। ও দেশের, এ দেশের নানা শহর থেকেই এমন ভিন্নস্বরের খবর পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কলকাতা? ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’? যেখানে কবিতা থেকে হোক কলরব, সব কিছুর জন্যই হাঁটা হয়? সেখানে কি এমন কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শুনেছি এখনও পর্যন্ত?
এই সব ভাবতে ভাবতেই আমার মনে পড়ে মাস চারেক আগের একটি সন্ধ্যার কথা। শ্রীনগরের ডাল লেকের জলে তখন লক্ষ্মীপূর্ণিমার সদ্য-ওঠা চাঁদের প্রতিচ্ছবি। হাউসবোটের দুঃখী ম্যানেজার এহসান, যার একটা চোখ গুলতি থেকে ছোড়া পাথর লেগে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যার প্রাক্তন বাঙালি বৌ তাকে প্রতারণা করে প্রেমিকের সঙ্গে ফের ফিরে গিয়েছে বাংলা মুলুকে, যে হাউসবোটের ম্যানেজার-কাম-রাঁধুনি হিসেবে এত সামান্য টাকা পায় যে সেই টাকা থেকে জমিয়ে অপারেশান করে নষ্ট চোখটা আগে সারাবে, নাকি কাশ্মীরি প্রথামতো কন্যাপণ দিয়ে আর এক বার বিয়ের চেষ্টা করবে, তা ভেবে পায় না— সেই চাঁদনি রাতে স্বগতোক্তির মতো বলছিল, ‘‘যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধবাজরাই আমাদের নষ্ট করে দিল। কে দখল নেবে এই মুলুকের, সেই প্রশ্ন নেতারা সাজায়, সেই প্রশ্ন দখল নেয় আমাদের জীবনের, অথচ আমরা তো ইন্ডিয়া নয়, পাকিস্তান নয়, শুধু একটু শান্তি চাই।’’ জানি না এই যুদ্ধের মরসুমে কেমন আছে ওই মুলুকের এহসানরা। শুধু টেলিভিশনে দেখেছি সীমান্তে চলেছে গুলির লড়াই, ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান দখল নিয়েছে সীমান্তবর্তী আকাশের, তাকিয়ে থাকলে অনেক সময় ভ্রম হয়েছে, ভিডিয়ো গেমস দেখছি না তো? বাস্তবিক অনেক চ্যানেলেই সিমুলেট করে দেখানো হয়েছে ‘আমাদের বিমান’, ‘আমাদের বায়ুসেনা’র সঙ্গে পাক বিমানের সংঘর্ষের যান্ত্রিক বিবরণ, ঘোষিকার দৃপ্ত উচ্চারণের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিলেছি সে সব।
এ সব দেখেশুনে আমি আবারও ভুগছি নস্টালজিয়া জ্বরে। মেহেদি হাসান, গুলাম আলিরা তো কত বারই এ দেশে এসেছেন শো করতে, কয়েক বছর আগেও কলকাতা লিটারেরি মিট-এর অতিথি হিসেবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গান গেয়ে গিয়েছেন ফরিদা খানম। কলকাতায় বড়-হয়ে-ওঠা রূপসি, ব্যক্তিত্বময়ী, অশীতিপর বৃদ্ধার রুপালি চুল আর হিরের নাকছাবিটি ঝিকিয়ে উঠছিল তরুণ প্রজন্মের আলি শেঠির সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপে। সঙ্গীতের সঙ্গে পরতে পরতে কথোপকথনে উন্মোচিত হচ্ছিল ভারতবর্ষের পুবের এই শহরে বৃদ্ধার বালিকাবয়সের স্মৃতিমালা। স্মৃতিমেদুর সুরেলা সেই সন্ধ্যা সীমান্তের সন্ত্রাসময় সন্ধ্যা থেকে কত আলোকবর্ষ দূরে?
আরও দূরে আধো আলোছায়ায় দেখতে পাই দূরতর, অন্য এক সন্ধ্যার স্মৃতি। অন্য এক দেশে এক দশক আগে ভারত আর পাকিস্তানের ছেলেরা এক সঙ্গে জড়ো হয়েছে ক্রিকেট খেলতে। আছে মার্কিন ছেলেরাও, যারা ঠিক জানে না, জিনিসটা খায় না মাথায় দেয়। আমার পুত্রের প্রাণের বন্ধু সেই হামজা, উজের, আমার, জিরাক, ওরা কে কোথায় এখন, আমি জানি না। তারাও কি আজ ভারতকে, ভারতের বাসিন্দাদের শত্রু ভাবে? কোথাকার বিরিয়ানি শ্রেষ্ঠ, সেই তর্ক ছেড়ে আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করে? তবে তো যুদ্ধ আর পশ্চিম সীমান্তে সীমাবদ্ধ নেই, ঘরের পরিসরেই এসে পড়েছে।
ঘরের কথা থেকে মনে হল এক স্বপ্নের কাহিনি। আমার ৯১ বছরের বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বললেন, ‘‘আজ একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি।’’ শুধোলাম, কী স্বপ্ন? বাবা বললেন, ‘‘দেখলাম, আবার দুই বাংলা এক হয়ে গিয়েছে। খুব আনন্দ হচ্ছে। মমতাকে (একই পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ‘লড়াকু মেয়ে’ হিসেবে বাবার সবিশেষ স্নেহ কাজ করে) ডেকে বলছি, তুমি পারো না ভারত আর পাকিস্তানকে এক করে দিতে?’’
এক সপ্তাহ আগে স্বপ্নটা শুনে বেজায় হাসি পেয়েছিল। এখন একটু তলিয়ে ভাবছি। আমার বাবার বিলুপ্তপ্রায় প্রজন্ম, যাঁরা বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, মন্বন্তর, দেশভাগের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছেন, জীবনের বিভিন্ন স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে জুঝেছেন জীবৎকাল জুড়ে, তাঁদের বহুবর্ণ, ভাঙাচোরা অতীত ঘুরে ফিরে সর্বসন্তাপহর দাওয়াই বাতলাতে থাকে, ফিসফিস করে মন্ত্রণা দেয় সুদিনের, দুই বাংলা, এমনকি ভারত-পাকিস্তানের মিলনের আকাঙ্ক্ষা সুষুপ্তির মধ্যেও চোরাগোপ্তা প্রণোদনা দিতে থাকে। তাই তাঁদের ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় পরতে পরতে দীর্ঘশ্বাসের মতো জড়িয়ে থাকে তাঁদের নিজস্ব স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস।