মেসুট ওজ়িল। ছবি এএফপি।
জার্মানিতে নন্দ ঘোষের নূতন নামকরণ হইয়াছে: মেসুট ওজ়িল। বিগত বিশ্বকাপে জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হইয়াছিল, বিজয়ী দলের শরিক হিসাবে স্বদেশবাসীর স্বপ্ন পূরণে বড় ভূমিকা লইয়াছিলেন ওজ়িল। এই বিশ্বকাপে যখন ফল হতাশাজনক হইল, তখন তাঁহারাই অনেকে আর ওজ়িলকে স্বদেশবাসী রাখিলেন না। তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রতিভাবান ফুটবলারটি হইয়া গেলেন ‘অভিবাসী’। ওজ়িলের অপরাধ, সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরডোয়ানের সহিত তাঁহার এক আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়। তাহার পর এই ফুটবলারের সমালোচনায় মুখর হয় জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ‘একনায়ক’ এরডোয়ানের সহিত তাঁহার ‘ঘনিষ্ঠতা’য় কূটপ্রশ্ন উঠে: জার্মান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি কি ওজ়িলের বিশ্বাস অটুট? অসম্মানিত ওজ়িল এই বিচার মানিয়া লইতে পারেন নাই। প্রতিপ্রশ্ন তুলিয়াছেন: জার্মানি জিতিলে তিনি নায়ক আর হারিলে তিনিই খলনায়ক? তিনি জানাইয়াছেন, ক্রীড়াজীবনের সূচনায় তাঁহার সম্মুখে দু’টি বিকল্প ছিল, তুরস্ক ও জার্মানি। ওজ়িল স্বেচ্ছায় জার্মানিকে নির্বাচন করিয়াছিলেন। আজ তিনি জানাইতেছেন, যে গর্ব লইয়া জার্মান জার্সি গাত্রে চাপাইতেন, দুঃসময়ে তাহা বিস্মৃত হইয়াছেন সকলে। কাজেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চ আর নহে।
ওজ়িলের কি ভূতপূর্ব স্বদেশের প্রধানের সহিত ফ্রেমবন্দি হইবার অধিকার নাই? মার্কিন অধিবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুন্দর পিচাই কিংবা সত্য নাদেল্লা দেশ-সফরে আসিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। বিতর্কের জন্ম হয় নাই। প্রকৃত সত্যটি হইল— বিতর্কের জন্ম হয় না, জন্ম দেওয়া হয়। স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক করিয়া তুলিতে পারিলেই তাহা সম্ভব। জার্মান ফুটবল সংস্থার যুক্তিটি অস্বাভাবিক, বৈষম্যমূলক। ওজ়িল কেমন খেলিলেন, দেশের হইয়া জয় আনিলেন কি না, এই যুক্তিতে তাহা গৌণ। তিনি এরডোয়ানের সহিত ছবি তুলাইয়াছেন, ইহাই তাঁহাকে চিনিয়া লইবার মাপকাঠি। এই সঙ্কীর্ণ একমাত্রিক জাতীয়তাবাদ অধুনা সর্বত্র প্রকট। রাজনৈতিক শত্রুর সহিত নৈকট্য দেখা দিলেই নাগরিক ‘দেশদ্রোহী’ কিংবা ‘পররাষ্ট্রপ্রেমী’ হইয়া উঠেন। আনুগত্যটিই সেখানে একমাত্র মাপকাঠি।
বহু ক্রীড়াবিদই এই রূপ বৈষম্যের শিকার হন, নীরব থাকেন, ওজ়িল সরব হইলেন। যেমন সম্প্রতি সরব হইয়াছিলেন বেলজিয়ামের ফুটবলার লুকাকুও। তিনিও বলিয়াছিলেন, বেলজিয়াম জিতিলে তিনি বেলজিয়ামের খেলোয়াড় হিসাবে বন্দিত হন, হারিলে আফ্রিকান খেলোয়াড় হিসাবে নিন্দিত। প্রতিবাদী স্বরগুলি মূল্যবান, জরুরি। এক জন মুখ খুলিলে অন্যরাও কথা বলিবার প্রেরণা পান, সাহসও। টেনিস খেলোয়াড় সানিয়া মির্জ়া যেমন জানাইয়াছেন, ওজ়িলের প্রতি এই আচরণে তিনি ব্যথিত। ওজ়িলের মতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়াছেন কয়েক জন জার্মান সতীর্থও। মূল সুর একটিই: জাতিপরিচয়ে ক্রীড়াবিদের বিচার হইতে পারে না। তাঁহারা অনেকেই আপন জীবনে এমন অন্যায় বিচারের সম্মুখীন হইয়াছেন, ওজ়িলের সমর্থনে সেই স্মৃতি আর এক বার উস্কাইয়া লইতে সক্ষম হইলেন। এই সমস্বরই হয়তো ক্রমে অতিজাতীয়তার একমাত্রিক আগ্রাসনের মহড়া লইতে পারিবে। হয়তো বা, পারিতেছে।