নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
প্রিয় পাঠক, গত এক মাস আপনাদের সঙ্গে কথা হয়নি। অসুস্থতার কারণে ছুটিতে ছিলাম। চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে বাড়িতে বসে টিভি চ্যানেলে সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম নীরব মোদিকে নিয়ে এক বিপুল সরবতা। জানেন, খুব মিস করতাম আপনাদের। প্রথম দিকে তো শুধু টিভি আর সোশ্যাল মিডিয়া অনুসরণ করতাম, চিকিৎসকের নির্দেশ ছিল অ্যালার্জেটিক ব্রঙ্কাইটিসে খবরের কাগজ পড়া চলবে না কিছু দিন। বাইরের ধুলো ঢুকবে। বুঝুন আমার অবস্থা!
যা হোক, শেষ দিকে অপরাহ্নে কাছে-পিঠে বেরনোর অনুমতি পেলাম। প্রথম দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর মার্কেটে। মিষ্টির দোকান থেকে কিছু কিনে টাকাটা দিতে যাচ্ছি, দেখি দোকানদার মন দিয়ে ক্যাশ বাক্স খুলে তখন টাকা গুনছে। বললাম, আমার কাছে থেকে এত অল্প টাকা মনে হচ্ছে তোমার নেওয়ার ইচ্ছেই নেই। জবাবে হাসতে হাসতে সে বলল, কোথায় টাকা দাদা? আমাদের ক্যাশবাক্স খালি করে নীরব মোদি সব টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল।
আমি বললাম, কী হবে এখন? এখন তো সরকার চোর ধরতে সমস্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। তা শুনে সে মিষ্টান্ন বিক্রেতার জবাব: টাকা কি আর ফেরৎ আসবে? চোর পালালে পর বুদ্ধি বেড়ে লাভ কী?
হাঁটতে হাঁটতে বাজারের ভেতর ঢুকলাম। ওখানে ঘড়ি সারানোর ছোট দোকানের মালিক বসেছিলেন। নাম তাঁর প্রদীপ ঘোষ। পাশেই শম্ভু পট্টনায়েকের কাগজের দোকান। সেখানে গিয়ে দেখি তুমুল তর্ক-বিতর্ক। বিষয় নীরব মোদীর ব্যাঙ্ক লুঠ। প্রদীপ ঘোষকে আমি ডাকি ‘ঘড়িবাবু’ বলে। ঘড়িবাবু বললেন, দাদা ওয়াটসঅ্যাপে দেখেছেন, কী বলছে সবাই? মোদী দুই প্রকার। এক প্রকার মোদী বিদেশে পালিয়ে যান লুঠ করে, দেশে আর ফেরেন না। আর এক প্রকার মোদী, যিনি বিদেশে গেলেও দেশে ফেরেন। তবে আমি আপনাকে বলছি, ২০১৯ সালের পর এই মোদীকেও বিদেশেই চলে যেতে হবে। ওখানে গিয়েই ওঁকে থাকতে হবে। শম্ভুদের দোকানে এক প্রৌঢ়া বাংলা ম্যাগাজিন কিনতে কিনতে শুনছিলেন আলোচনা। তিনি মন্তব্য করলেন, উনি ফিরুন আর না ফিরুন, কোটি কোটি টাকা তো লুঠ হয়ে গেল, সে টাকা কি আর ফেরত পাওয়া যাবে? আর এক খদ্দের বললেন, পিএনবি-তে কি আপনার টাকা ছিল? আপনার টাকা তো লুঠ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ওই মহিলা ফস করে বলে উঠলেন, আমার টাকা আপনার টাকা মানে, এ সবই তো আমাদের টাকা, ভারতীয় নাগরিকের টাকা, পাবলিক মানি। সে টাকা কি নরেন্দ্র মোদী নামক চৌকিদার ফেরত আনতে পারবেন?
দুর্নীতির প্রতিবাদে এনসিপি সমর্থকরা। মুম্বইয়ে। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।
বুঝলাম বাজার টগবগ করে ফুটছে। ছোটবেলায় বাজার যেতে একদম ভাল লাগত না। নরেন্দ্রপুরে পড়তাম। হস্টেল থেকে বাড়ি এলেই বাবা আমাদের হাওড়া মন্দিরতলার শিবপুর বাজারে পাঠাত। আমি বলতাম, প্যাচপ্যাচে কাদা, মাছের গন্ধ, নোংরা আবর্জনা ভাল লাগে না। বাবা বলতেন, বাজার তো বাজার নয়, আমাদের সমাজ। আমাদের দেশ। নিম্নবর্গ থেকে মধ্যবিত্ত। কে কী ভাবছে? এখন আমরা বলি মুড অব দ্য নেশন। এখন বুঝি, বাজার জীবন্ত এক ল্যাবরেটরি। বোকাবাক্সের চেয়েও বেশি প্রত্যক্ষ!
বিন্দুতেই সিন্ধু দর্শন। বুঝতে পারছি, চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এখন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার সম্পর্কে মানুষের দ্রুত মোহভঙ্গ হচ্ছে। অসন্তোষের পারদ ক্রমবর্ধমান। এমনটাই তো হয়। এ তো নতুন কিছু নয়। বিজেপি নেতারা যে সেটা বুঝতে পারছেন না, এমন নয়। তাঁরা রাজনৈতিক, আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ নন, তাই তাঁরা এ সব কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না। একে বলে পলিটক্যাল কারেক্টনেস। তবে এই নেতারাই অব দ্য রেকর্ড বিশ্বাস করলে আমাদের সাংবাদিকদের কাছে মনের কথা প্রাণের কথা বলেন। বিজেপির এক শীর্ষনেতা (তার নাম সাংবাদিকতার নৈতিকতার শর্তে গোপন রাখতে বাধ্য হচ্ছি) বিহার বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হওয়ার পর বলেছিলেন, জয়ন্তজি, হামহারে দেশমে এক চুনাও এক নেতাকে ছবি সামনে রাখকে আপ কর সকতে হ্যায়। দুসরা চুনাও ওহি ছবি দিখাকে জিতনা মুশকিল হোতা হ্যায়। মোদী ঘনিষ্ঠ ওই শীর্ষ বিজেপি নেতা তাঁর অফিসঘরের অ্যান্টি চেম্বারে আমার সঙ্গে নিরামিষ মধ্যাহ্নভোজন সারতে সারতে বলেছিলেন, ২০১৯ মে ওহি অসম্ভব কো সম্ভব করনা হামহারা কাম হ্যায়। আমি বললাম, বুঝেছি বুঝেছি, শোলে কি দু’বার হয়! ও যা হওয়ার তা এক বার হয়ে গেছে। শোলেকে নকল করে বার্নিং ট্রেন বা চায়না গেটের মতো ছবি বানানোর চেষ্টা হয়েছে। শোলে হয়েছে কি? হয়নি, ফ্লপ করেছে। ২০১৯-এর ভোটে মোদির দ্বিতীয় অধ্যায় তাই সহজ নয়, এ কথা বিজেপিও মানছে।
আরও পড়ুন: মোদী সরকারের শিক্ষানীতিই ঘোষণা হল না
বন্ধু সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও প্রচ্ছদ নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে, ২০১৯-এর ভোটে কেন নরেন্দ্র মোদীর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? বিজেপির আর এক নেতা সে দিন ফোন করেছিলেন আমি অসুস্থ শুনে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নীরব মোদির ঘটনায় দলের আসল প্রতিক্রিয়া কী? তা ওই নেতাটি বললেন, ২০১৪ সালে মোদীজি বলেছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান না, এ দেশের চৌকিদার হতে চান। যাতে দেশের ভেতর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি বন্ধ হয়। এই কথায় মানুষ বিশ্বাস করেছিল। ভারতীয় ভোটারের মনে হয়েছিল, এক জন পাহারাদার প্রধানমন্ত্রী হবেন মোদীজি। মানুষের এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশার ফায়দা ২০১৪ সালে মোদীজি ও বিজেপি পেয়েছে। এই উন্মাদনা তৈরি না হলে ২৮২টা আসন পাওয়া তো সম্ভব হত না। আবার এখন ২০১৯-এ তার খেসারতও তো আমাদের চোকাতে হবে। এ তো প্যাকেজ ডিল।
এটাই বাস্তব পরিস্থিতি। মোদীজি ও বিজেপির মুখপাত্র ও কিছু সমর্থক সাংবাদিক লিখেছেন, বিরোধীরা নীরব মোদীর লুঠকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী নিজে লুঠের ভাগ পেয়েছেন, এমন কোনও প্রমাণ তো নেই। তাই এই কুৎসা প্রচার অভিযান চালিয়েও মোদীকে ঘায়েল করা সম্ভব হবে না। নরেন্দ্র মোদীকে দোষ দিয়ে লাভ কী? অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, সব দায় সরকারকেই নিতে হবে কেন? নজরদারির দায়িত্ব সবসময়ই রাজনীতিকদের, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তো প্রশাসক-আমলাদের। অসাধারণ! বিরোধী দলে থাকার সময় এ কথা বিজেপি নেতারা বলেননি সে দিন, তো নরেন্দ্র মোদী একাই সুপারম্যানের মতো ‘অচ্ছে দিন’-এর সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নেন।
নীরব মোদীর ছবি পুড়িয়ে প্রতিবাদে কংগ্রেস সমর্থকরা। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।
নীরব মোদীর ব্যাঙ্ক লুঠের সব কথা নরেন্দ্র মোদী জানতেন কি জানতেন না, সে ব্যাপারে আমার কোনও মত নেই। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এই লুঠতরাজের জন্য মোদী সরকার দায়ী। আচ্ছা, বোফর্স ঘুষ-কাণ্ডের তদন্তে তো সিবিআই এত বছরেও কোনও প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু ‘৮৯ সালের ভোটের সময় বিজেপির প্রচার তো আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম। মনে আছে, বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ ইলাহাবাদ উপনির্বাচনের সময় এক জনসভায় বলেছিলেন, বোফর্সের ঘুষ খেয়ে রাজীব গাঁধী দেশ কা প্যায়সা বিদেশ মে ইতালি মে শ্বশুরালমে ভেজ রাহা হ্যায়। মানুষ হাততালি দিয়েছিল। রাজীবকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল মানুষ। সেই বিশ্বনাথপ্রতাপ, মৃত্যুর আগে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে বোফর্স রাজনীতির জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। বিজেপিকে স্লোগান দিতে দেখেছিলাম, গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়। দেশের আর্থসামাজিক সঙ্কটে সেই প্রচার ভোটের সময় মানুষ বিশ্বাস করে। যাকে বলে মানুষ ‘খেয়েছিল’।
আরও পড়ুন: রাজস্ব নেই, বিদেশি লগ্নি নেই, আর্থিক ঘাটতি ভয়াবহ
অতএব, শাহি দিল্লিতে এখন ভোটের হাওয়া। ২০১৯ দরজায় কড়া নাড়ছে। সংসদের ভিতরেও প্রতি দিন যে অসন্তোষের ঝড়, তাও তো ভোটমুখী রাজনীতি। অনাস্থা প্রস্তাব নিয়েও কত রাজনীতি। কত নাটক। আসলে কে যে অনাস্থা প্রস্তাব চাইছে আর কে চাইছে না তা নিয়েও বিতণ্ডা কম নয়। একে বলা হয় প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি। এ দিকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আছে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তা হলে যখন আর এক বছর পরেই লোকসভা নির্বাচন তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও জগন রেড্ডি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন কেন? আর এমন একটা সময় জগন রেড্ডি এ প্রস্তাব আনলেন যখন চন্দ্রবাবু নাইডু এনডিএ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন? জগনের সংসদ সদস্য সংখ্যা কত? মাত্র ৯। চন্দ্রবাবু নাইডুও পাল্টা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। সরকার বলছে ভোটাভুটি হোক। বিরোধীরা বলছেন, অনাস্থা প্রস্তাব আনা হোক। বাস্তবে কিন্তু কেউই অনাস্থ প্রস্তাবের ভোটাভুটি চাইছে না। এর মধ্যেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে ভোট। ভোটের ফলাফল কী হবে তা বলা যায় না। ২০১৯-এর ভোটের আগে তো কর্নাটক ও আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট আছে।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনই এখনও বলা যায় না হিন্দি বলয়ে মোদীর বিরুদ্ধে হাওয়া তৈরি হয়েছে। শুধু হিন্দি বলয় কেন, সমগ্র দেশেই সে ভাবে মোদী বিরোধী হাওয়া দেখছি কই? পরিস্থিতি তাই জটিল।