শুধু গৌরী লঙ্কেশ নয়, কোটি কোটি ভারতীয়ের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা! এ যে ভূতের মুখে রামনাম! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালসংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা! এ যে ভূতের মুখে রামনাম! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৪১
Share:

গৌরী লঙ্কেশ। ফাইল চিত্র।

শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৭ নভেম্বর, জাতীয় সংবাদমাধ্যম দিবসে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত দেশের প্রতিটি মানুষকে তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, এক উজ্জ্বল গণতন্ত্রের ভিত্তিই হল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা বজায় রাখতে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর।

Advertisement

একেই বলে ভূতের মুখে রামনাম! বক্তৃতার একটি বিশেষ গুণ, বক্তৃতা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সে ক্ষমতা সুবিদিত। কথার কথকতায় তিনি যাদুকর। কথাশিল্পী তিনি। তিনি বলেছেন, সংবাদমাধ্যম কণ্ঠহীনকে কণ্ঠদান করে। তবু প্রধানমন্ত্রীর এই নেশা ধরানো বাঙময়তার মধ্যে কেন যে বার বার গৌরীলঙ্কেশের কথা মনে পড়ছিল কে জানে। গৌরীলঙ্কেশ এই ভারত নামক দেশটাকে বিশ্বাস করেছিলেন যে দেশটাতে তিনি বসবাস করতেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, যেটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন। কিন্তু গৌরীলঙ্কেশের ভারতের প্রতি আস্থা এবং গণতন্ত্রের ভালবাসার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হল। আসলে শুধু গৌরীলঙ্কেশ তো নয়, কোটি কোটি ভারতীয়ের সঙ্গেই তো বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর আশ্বাসমাখা প্রবচন শুনে ঘর পোড়া গরুদের মনের ভয় যায় না এই এক সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী তো চাইছেন সংবাদমাধ্যম কণ্ঠহীনদের কণ্ঠ দেবে, কিন্তু সে কণ্ঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদী কণ্ঠ। সে কণ্ঠস্বরে ভারত এক হিন্দু পাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী যা বলছেন তা ভূতের মুখে রামনাম কেন মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে এ জন্য যে আজ গোটা দেশের আবহ এক বিপ্রতীপ পরিস্থিতিতে বিরাজমান। ভিন্ন মত পোষণ করা মানে কিন্তু বিষোদ্গার নয়, ভিন্ন মত আছে বলেই তো বহুত্ববাদ। মুক্ত চিন্তার এই পরিসর বেঁচে থাকে যখন রাজনৈতিক নেতা বা শাসক শ্রেণির সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের উভমুখী ভাবনাচিন্তার দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়া সজীব থাকবে। আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী গত তিন বছরে একটিও সাংবাদিক বৈঠক করলেন না। তাঁর যা জানানোর তা ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই জানিয়ে দেন। এ হল একমুখী প্রক্রিয়া। এমনকী, ফি বছর তিনি যে দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিওয়ালি মঙ্গল মিলনে আসেন, মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেন, তার পর ভিড়ের মধ্যে এসে হাসি, করমর্দন, নিজস্বী। এ কি কোনও মত বিনিময় না কি এক ধরনের অলীক বাস্তবতা নির্মাণের কৌশল। বাস্তবতাকে বর্জন করে সংবাদমাধ্যমে কল্পনার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলছেন তখনই রাজস্থানে অধ্যাদেশ করে সরকার সংবাদমাধ্যমের অধিকার কেড়ে নিতে তৎপর। প্রতিবাদে জাতীয় সংবাদমাধ্যম দিবসে রাজস্থান পত্রিকার প্রধান সম্পাদকীয় স্তম্ভটি শূন্য রাখা হয়। বিশ্ব সাংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক সম্পর্কিত ২০১৭ সালের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ১৩৬ নম্বর স্থানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা প্রচারের কথা না হয় বাদই রাখলাম।

বিহারে জগন্নাথ মিশ্র যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন ভাগলপুরে বহু বন্দিকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম উত্তাল হয়ে উঠেছিল। জগন্নাথ মিশ্র বিহারে ১৯৮২ সালে প্রেস বিল আনেন। তখন আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কলেজ স্ট্রিট থেকে এসপ্ল্যানেড ইস্ট পর্যন্ত প্রেস বিলের প্রতিবাদে মিছিল করেছিলাম। জগন্নাথ মিশ্র এখন বেঁচে আছেন। দেখলাম, তিনি বলছেন, আমার বিহার প্রেস বিল ভুল ছিল। কিন্তু রাজস্থানের ২০১৭ সালের অধ্যাদেশ আরও ভয়াবহ। রাজীব গাঁধী প্রেস নিয়ন্ত্রণ বিল এনেছিলেন, কিন্তু সংবাদমাধ্যম ও বিরোধীদের প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে লোকসভায় এসে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাহার করে নেন। জরুরি অবস্থার সময়েও সংবাদমাধ্যম একই ভাবে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। সাংবাদিকেরা জেলে গিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপসহীন সে লড়াইয়ের জয় হয়েছে।

মোদীও বলছেন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা!

আজ জরুরি অবস্থা জারি হয়নি। মোদী সরকারের রণকৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেন না। কিন্তু দিল্লির দরবারে বহু মানুষের জানা, কী ভাবে নেপথ্য থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে সম্পাদককে পর্যন্ত ইস্তফা দিতে হয়। সংবাদমাধ্যমের মালিক ও সাংবাদিকদের উপর কী ভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অলিখিত নির্দেশ একটাই, চলো নিয়মমতো। সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে প্রকাশ্য দিবালোকে গলা টিপে হত্যা করে সেনাবাদ। একনায়কতন্ত্র। গণতন্ত্রে তা কেন হবে? ২৮২-র গণতন্ত্রের স্বরূপ ভিন্ন। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার নামাবলির আড়ালে আছে এক ভয়ের অনুশাসন। সম্পাদকীয় সমর্থন এবং বিজ্ঞাপন রাজস্বের এক চিত্তাকর্ষক সুনিয়ন্ত্রিত বোঝাপড়া। নৈতিকতা, মতাদর্শ সাংবাদিকের মুক্ত চিন্তা ও সব আবার অতীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ছিল। এখন সংবাদমাধ্যমের বৃহৎ ব্যবসাকেও রাজনৈতিক বাস্তববাদের কাছে নতি স্বীকার করতেই হবে। এই বিশ্বাসে শাসক গোষ্ঠী অর্থ বলে, বাহুবলে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সংবাদমধ্যমকে। এরই মধ্যে কোনও সাংবাদিক নিহত হন, কেউ জেলে যান, কেউ কেউ চাকরি হারান।

১৯২২ সালের ১৩ মার্চ কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত হয়। স্বদেশ ও স্বরাজ ছিল সে দিন মূল মন্ত্র। আর ১৯২৬ সালে দণ্ডবিধির ১৫৩ (ক) ধারা অনুসারে সরকার বাহাদুর আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ১৯২৭ সালের ২৫ জুলাই সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৭ সালে স্বাধীন আধুনিক ভারতের বিদেশি রাজশক্তি নেই। কিন্তু আজ রাজধানীতে বসে সাংবাদিকতার মুক্তচিন্তার উপর যে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেখছি তা অভূতপূর্ব। স্বাধীনতার এ এক মন্বন্তর। মহাশ্মশানের পিশাচনৃত্য।

ছবি নির্মাতা চলচ্চিত্রে কিছু করতে গেলেই আসছে সরকারি বাধা, সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বশাসনে বিচিত্র নির্লজ্জ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। গণতন্ত্রের সর্বাঙ্গে যেন মারি-গুটিকা দেখা দিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের কোনও দোষ নেই, এমন কথা বলছি না। অনেক সময় ভুল সংবাদ পরিবেশনার ফলে আমারাও না জেনে সমাজের ক্ষতি করে ফেলি। ইভেন্ট নির্মাণের নিষ্ঠুর কর্পোরেট প্রতিযোগিতা আজ হঠাৎ শুরু হয়েছে এমন নয়। বার্ট্রান্ড রাসেলের বলা সেই মজার গল্পটা মনে আছে? এক পাল হাতি নীরবে সুশৃঙ্খল ভাবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা এরোপ্লেনকে আকাশে সশব্দে উড়তে দেখে হাতির পাল ছত্রভঙ্গ। গাছটাছ কিছু ভাঙল। কিন্তু তার পরই যখন বিমানটি অদৃশ্য হল, আকাশ নীরব হল। হাতিরা আবার যূথবদ্ধ। সারি দিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে হেঁটে যেতে লাগল। রাসেলের রসিক মন্তব্য: সে দিন এত বড় একটা কাণ্ড হতে পারত, হয়নি কেন জানেন? ওই হাতির পালে কোনও সাংবাদিক ছিল না।

তাই আমরা নির্দোষ বলছি না। কিন্তু ব্যতিক্রমই সত্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিক অন্য যে কোনও পেশার মতোই সত্যকে সত্য বলে আর মিথ্যাকে মিথ্যা। আবার আজ সুকৌশলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মিথ্যা-অতিরঞ্জন দিয়ে যে ইতিহাস রচনা করছেন এই সংবাদমাধ্যমকেই বলির পাঁঠা করে। তার বেলা? বিসমার্কের অতিরঞ্জিত টেলিগ্রাম ১৮৭০ সালে সেডানের যুদ্ধ ডেকে আনে, আর এখন আবার মিথ্যা-অতিরঞ্জন দিয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়ার চেষ্টা চলছে। নেহরু-গাঁধীর বহুত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধতায় গড়ে তোলা হচ্ছে এক অন্য মোদীর ভারত। সে ভারতের কল্পরাজ্যের বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরের পরিসর মানতে রাজি নয় বিজেপি। কিন্তু বিদ্রোহের তপর্ণও হল এক বিজ্ঞান। তাই ভূতের মুখে রামনামে সাময়িক নেশাচ্ছন্ন হতে পারে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সমস্ত মানুষকে চিরকালের জন্য বোকা বানানো?

-না মুমকিন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন