মা ও ছেলে: রামকিঙ্কর বেজ-এর ছবিতে ফুটে উঠেছে মা ও সন্তানের পরিবারের দিনলিপি। যেখানে বিত্ত নয়, ভালবাসাই মূল সম্পদ
বেশ বুঝতে পারছি, এ বার পুজোয় সুবোধ রায় আমাকে জ্বালাবেন। গতবার পুজোয় কয়েক দিন ধরে শুধু মায়ের কথা ভেবেছিলাম। কত দুঃখের মধ্যে তিনি আমাদের সারাক্ষণ রক্ষে করবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কী অসীম সাহসে তিনি বিপদের বৃত্রাসুরকে দূরে সরিয়ে রেখে আমাদের মানুষ করেছিলেন তা ছোটবেলায় ঠিক বুঝতে পারিনি, আর এখন দুর্গতিনাশিনী দেবীর সঙ্গে আমার গর্ভধারিণী জননীর কোনও পার্থক্য দেখতে পাই না। চোখ বুজলে আমার মাকেই দশভুজা দুর্গার মতো দেখতে পাই। শুধু একটি মাত্র পার্থক্য, মৃত্তিকার মূর্তিময়ী লাল রঙে বিভূষিতা, তাঁর সর্বাঙ্গে নানা উজ্জ্বল সমারোহ, আর আমার মা বিষণ্ণ বৈধব্যের প্রতিমূর্তি। একটি সাদা থান ধুতি পরে তিনি মাত্র দুটি হাতেই দশভুজার বিপুল বিক্রমে সমস্ত বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।
পুজোর সময় মা চিরকালই দায়িত্বের বাড়তি বোঝা বহন করেছেন। বিবাহের পূর্বে তিনি ছিলেন অনেকগুলি সমর্থা অথচ অবিবাহিতা কন্যার একজন। আমার বদমেজাজি দাদু অফিসে এক দুর্বিনীত ইংরেজ নন্দনকে চপেটাঘাত করে জাতীয় কর্তব্য পালন করলেও, কর্মহীন অবস্থায় নিজের সন্তানদের প্রতি প্রাথমিক কর্তব্যও পালন করতে পারেননি। দ্বিতীয় পক্ষের সংসারে এসেও পুজোর সময় মা কখনও পরিপূর্ণ আনন্দ পাননি। যখন খরচ বাড়ে তখন বাবার রোজগার কমে যেত, পুজোর নাম করে আদালত অনেকদিন বন্ধ ও উকিলদের আয় থাকে না। তৃতীয় পর্বে তো কথাই নেই— তখন পুজো আছে, ছেলেমেয়েদের বায়না আছে, কিন্তু স্বামী নেই এবং উপার্জনের পথও নেই। সামান্য যা সঞ্চয় ছিল তা সেবার ব্যাঙ্ক ফেল করে নিঃশেষ হল। তবু মা ছিলেন সত্যিই লক্ষ্মীস্বরূপা, প্রতি পুজোয় আমাদের কিছু নতুন দিতেন। একবার আমাকে জামা দিতে না পেরে গেঞ্জি দিয়েছিলেন।
আমি তখনও দুঃখের কথা কিছুটা বুঝতাম। ভাবতাম, আর কয়েকটা দিন যাক, আমিও অনেক রোজগার করব এবং টাকা পেয়ে চুপি চুপি দোকানে গিয়ে মায়ের জন্য ঝলমলে বেনারসি কিনে এনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব। মূর্খ আমি! যখন আমার উপার্জনক্ষমতা হল তখন বুঝলাম, সন্তান যত অর্থই রোজগার করুক, বিধবা মাকে রঙিন বেনারসি পরাবার সামর্থ্য তার কোনওদিনই হবে না।
মায়ের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে আমার তেমন জ্ঞান হয়নি, যতদিন না আমার সুবোধ রায়ের সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হল। সুবোধ রায় অনেকদিন ইহলোক ত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। যাঁরা অনেক দূর সরে গিয়েছেন পুজোর ক’দিন তাঁরাই তো আমার কাছে এসে হাজির হন।
আমার প্রথম বই ‘কত অজানারে’ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক শুরু হওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ই ছিল না। আমি তখন চৌধুরীবাগান লেনের এক অবিশ্বাস্য সর্পিল গলির শেষ প্রান্তে থাকতাম, স্রেফ ঠিকানার জোরে যেখানে কাউকে খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শনিবার এক উত্তপ্ত অপরাহ্নে প্রচণ্ড জোরে কড়া নাড়া আরম্ভ হল। দরজা খুলে দেখলাম ছোট্ট সাইজের রোগা বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে আধময়লা পাঞ্জাবি ধুতি ও পায়ে একটা ভারি শু। মাথার চুল ছোট করে কাটা।
ভদ্রলোক ছাতিটি বগলে রেখে সুগম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি অমুক নম্বর এবং অমুক কি এখানে থাকে? আমিই যে অমুক এই বলতেই ভদ্রলোক তিড়িং করে ভিতরে ঢুকে এলেন এবং জুতো সমেত ঘরের তক্তপোষে উঠে বসলেন। দারুণ রোদে ভদ্রলোক প্রচণ্ড ঘেমেছেন। বললেন, ‘অনেক কষ্টে দেশ পত্রিকার আপিস থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছি।’ তারপর হুমকি ছাড়লেন, ‘মা আছেন?’ আমি বললাম, ‘মা রান্নাঘরে রয়েছেন।’ ‘ডাকো, ডাকো’, তড়িৎ-ঘড়িৎ নির্দেশ। ভিতরে গিয়ে মাকে খবর দিলাম। ‘মা রান্নাঘরে কাজ শেষ করে বাসন মাজছেন। আসবেন এখনই’, বলতে বলতে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি ভয়ানক অবস্থা। ভদ্রলোক ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বোধহয় বুকের যন্ত্রণা হচ্ছে।
আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।
ভদ্রলোক তখনও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলছেন, ‘মা কোথায়? মাকে ডাকো।’
মা এলেন। তাড়াতাড়ি ভদ্রলোকের পাঞ্জাবিটা খুলিয়ে মাথায় একটা বালিশ দিলেন। তারপর দুখানা হাতপাখা নিয়ে দু’জনে খুব জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগলাম। একটু পরে মা খাবার জল আনলেন। ভদ্রলোক জল খেলেন। তারপর ইঙ্গিতে মাকে পাখা টানা বন্ধ করে আমাকে হাওয়া চালাতে বললেন। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে একটু সুস্থ হয়ে উঠে বসলেন। এবং হঠাৎ তি়ড়িং করে উঠে পড়ে মাকে প্রণাম করলেন। জানা গেল আমার অনুরাগী প্রথম অপরিচিত পাঠকটির ডাইলেটেড হার্ট, রক্তের উচ্চ চাপ, প্রবল হার্নিয়া এবং নানাবিধ ব্যাধি।
আরও পড়ুন: ভাগবতের তোপে বাংলা-কেরল
মা ততক্ষণে কয়েকখানি বাতাসা এবং একটু কুঁজোর জল আনতে গিয়েছেন। আমি ভাবলাম এইবার ভদ্রলোক বোধহয় সুস্থ হয়ে আমার সঙ্গে কিছু সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করবেন। কিন্তু সে রকম কোনও আগ্রহ নেই। মাকে দেখার জন্য সুবোধ রায় অধীর হয়ে উঠেছেন।
মা এলেন। সুবোধ রায় বললেন, ‘আপনার ছেলে ভাবছে, তাকে দেখতে আমি এই রোদ্দুরে প্রাণ হাতে করে এখানে এসেছি। লেখকদের দেখে কোনও লাভ নেই। ওদের পরিচয় ওদের লেখায়। গাছের পাতার নমুনা দেখে আমার মাথায় ভূত চাপল, আসল গাছটাই দেখব। তাই ছুটে এসেছি।’
মায়ের সঙ্গে গল্প করতে বসলেন সুবোধ রায়, আমাকে ছুটি দিয়ে দিলেন, ইচ্ছে করলে আমি উপরে গিয়ে লেখা চালাতে পারি।
এই বৃদ্ধ অসুস্থ অথচ প্রাণবন্ত সাহিত্যরসিকটির সঙ্গে মায়ের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সুবোধবাবু আমাকে তেমন পাত্তাই দিতেন না, খোদ গাছের সঙ্গেই সাহিত্য সম্পর্কে নানা কথাবার্তা বলে বিদায় নিতেন। বলতেন, ‘লেখার পূর্ণ রসাস্বাদন করতে হলে লেখকের জীবনকে জানা চাই যারা বলে তারা বোকা, লেখা যদি সত্যিই বুঝতে চাও, তাহলে লেখকের মাকে জানো।’
আমার একটা বদঅভ্যাস আমি অসমাপ্ত অবস্থায় পাণ্ডুলিপি কাউকে দেখাতে চাই না। ভীষণ লজ্জা লাগে এবং অস্বস্তি হয়। সে সময় চৌরঙ্গী লেখা চলছে। লেখাটা বড্ড বেশি সময় নিচ্ছে। সুবোধ রায় মাঝেমাঝে এসে লেখার খোঁজখবর নেন। আবার ষষ্ঠীর দিন সকালে সুবোধ রায় তাঁর অসুস্থ শরীর নিয়ে চুঁচড়া থেকে হাওড়ায় হাজির হলেন। মায়ের সঙ্গে তাঁর কীসব কথাবার্তা হল। মা আমাকে ডাকলেন। ‘সুবোধবাবুর শরীর খুবই অসুস্থ। পুজোর দিন সকালে একটুখানি লেখা শোনবার আশায় বেচারা কোথা থেকে ছুটে এসেছেন, অথচ ডাক্তারের নির্দেশ শুয়ে থাকার। আমাকে বলছেন, আপনি ছেলেকে নির্দেশ দিন। তা হলে ও আমাকে একটা চ্যাপ্টার পড়তে দেবে।’
মহাষষ্ঠীর দিন। মায়ের নির্দেশ অমান্য করতে পারলাম না। অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে নেমে এলাম। মুখে বোধহয় একটু বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। খুব মন দিয়ে তিনি একটা পরিচ্ছেদ পড়তে লাগলেন। আমি এই দুঃসহ অবস্থার সামনে বসে থাকতে পারলাম না। ওপরে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরে মা আমাকে ডাকলেন। দেখি আমার পাণ্ডুলিপিটা তক্তপোষের ওপরে পড়ে রয়েছে। মা বললেন, ‘হ্যাঁরে, তোর নতুন বইতে কী লিখেছিস? ভদ্রলোক লেখা পড়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে নিজের ছাতাটি নিয়ে চলে গেলেন। তোকে ডাকতেও বললেন না।’
এর পর উনি আর কখনও আমাদের বাড়িতে আসেননি। চৌরঙ্গী যখন প্রকাশিত হল, তিনি ইহলোকে নেই। মায়ের কথা মনে পড়লেই আমার সুবোধ রায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার কেমন যেন আশঙ্কা, এবার পুজোয় সমস্ত পৃথিবী যখন আনন্দে মত্ত হবে, তখন সুবোধ রায় আবার আসবেন, এবং গাছের পাতা দেখে সন্তুষ্ট না হয়ে খোদ গাছেরই খোঁজখবর করবেন।
প্রথম প্রকাশ: ‘আমার পুজো’ শিরোনামে, পুজো ক্রোড়পত্র, ১৯৮৫। সংক্ষেপিত