Misogyny

কিছু আশা, কিছু সম্ভাবনা

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর বেশ খানিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে দেশের বহু অংশ।

Advertisement

তাজুদ্দিন আহমেদ

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৩
Share:

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর বেশ খানিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে দেশের বহু অংশ। এক দিকে যেমন দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের মতো করে কর্মসূচি সংগঠিত করেছে, অন্য দিকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রাথমিক পর্বে হিংসাত্মক কিছু ঘটনা ঘটলেও, আন্দোলন বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ ভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বিরোধী এই আন্দোলনে মুসলিমদের সঙ্গে পা মিলিয়ে মিছিলে হাঁটছেন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে। প্রতিবাদ প্রায় গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছে।

Advertisement

এই আন্দোলনে যে ভারতীয় মুসলিমেরা বিপুল সংখ্যায় অংশ গ্রহণ করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ কেন্দ্রের মোদী সরকারের সমস্ত রকম মুসলমান-বিরোধী নীতি এবং কর্মকাণ্ড যেন চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মধ্যে। স্বভাবতই তাঁদের স্লোগানে উঠে আসছে ‘আজাদি’র দাবি। রাষ্ট্রের সমর্থনে পুষ্ট হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন থেকে ‘আজাদি’র দাবি মুসলমান সমাজের এক অভ্যন্তরীণ মন্থন, যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে কয়েকটি বিষয়।

প্রথমত, এই আন্দোলন সংগঠিত করা এবং তাতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজের বৃহদংশ এক ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। অনস্বীকার্য যে, আইনটি পাশ হওয়ার অব্যবহিত পরে যে সব প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছিল চরিত্রগত ভাবে সেগুলি ছিল ধ্বংসাত্মক, এবং বহু মুসলিম তাতে অংশও নিয়েছিলেন। হিংসার পথ নেওয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছিল প্রতিবাদের এই ধরন। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে দ্রুত। আন্দোলন সুশৃঙ্খল, গণতান্ত্রিক ও অহিংস ভাবে গলি, মহল্লা থেকে রাজপথ এবং পার্কে নিয়ে এসেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা, কণ্ঠ মিলিয়েছেন অন্য সম্প্রদায়ের কণ্ঠের সঙ্গে।

Advertisement

এই রাজনৈতিক বিচক্ষণতার আর একটি দিক হল আন্দোলনের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এই দৃশ্য বিরল নয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় সেই সব আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে তার দিশা নির্দেশ করেছেন রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় নেতৃত্ব। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলনের রাশ কিন্তু সেই ভাবে মুসলিম ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নেই। স্বতঃস্ফূর্ত এই জনআন্দোলনের পরিচালনায় রয়েছেন এমন অনেক মানুষ, যাঁরা সরাসরি ধর্ম বা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে নেই। দাবি আদায়ের আন্দোলনে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে এই ‘আজাদি’, দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। এক, এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে মুসলিম সিভিল সোসাইটির উত্থানের একটি সম্ভাবনা। মুসলিম সমাজে শক্তিশালী সিভিল সোসাইটির অভাবের দরুন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব, মত প্রকাশ এবং নেতৃত্বের রাশ বহু দশক ধরেই থেকেছে রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় নেতাদের হাতে। দুই, যে প্রত্যয়ের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতৃত্বের হাত না ধরেই প্রতিবাদের পথে হাঁটছে তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে দেশের অন্যান্য, বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়েরও। দেশের সংবিধানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে এত মানুষের এই ভাবে পথে নামা নিশ্চিত ভাবেই সংখ্যালঘু মানুষদের আশ্বাস ও সাহস জুগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমরা উভয়েই এক দেশের সন্তান— আমরা ঈশ্বরকৃত সেই ধর্মের বন্ধনবশত, শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক্।’’ আজ যখন হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে মুসলমানের পাশে হিন্দু বা শিখ অক্লান্ত ভাবে হেঁটে চলেন, তখন নিশ্চয় এক সাধারণ মুসলমান অনুভব করেন যে ‘আমরা উভয়েই এক দেশের সন্তান’ এবং এই লড়াই তাঁর একার নয়। ‘আরও হাতে হাত রেখে’ ‘আরও বেঁধে বেঁধে’ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই আন্দোলনে মুসলিম মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ। মাসাধিক কাল ধরে চলছে দিল্লির শাহিন বাগের জমায়েত। সেই জমায়েতের অনুপ্রেরণায় কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দান, ইলাহাবাদের রোশন বাগ, পটনার সবজি বাগ এলাকা, কানপুরের চমনগঞ্জ, গয়ার শান্তি বাগ-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমান মহিলারা শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন চালাচ্ছেন। সমাজের সব স্তর থেকে আসা মুসলমান মহিলাদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেতাদুরস্ত মহিলা আধিকারিক এসে বসছেন দরিদ্র অটোচালকের প্রৌঢ়া স্ত্রীর পাশে, একসঙ্গে ‘আজাদি’র দাবি জানাচ্ছেন উচ্চবিত্ত পরিবারের পর্দানশিন গৃহবধূ এবং কলেজ পড়ুয়া কিশোরী। এঁদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা কখনওই পরিবারের পুরুষ সদস্যের তদারকি ছাড়া বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে বার হননি। মুসলিম মহিলাদের এই আন্দোলন এক দিকে তাঁদের চূড়ান্ত শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে, অপর দিকে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে ওঠা আলোড়নের প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই আলোড়ন, সেই মন্থনের ফলেই আজ পর্দা এবং সংস্কারের মতো পুরুষতান্ত্রিক বেড়া সরিয়ে আন্দোলনের সামনের সারিতে এগিয়ে আসছেন মুসলিম মহিলারা। এও কি এক ধরনের ‘আজাদি’ নয়?

কতটা পথ পেরোলে দেশজোড়া এই আন্দোলন কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী শাসকের বিভাজনের রাজনীতিকে পরাজিত করতে পারবে, কেউ জানে না। এই উদ্দীপনা, এই মন্থন আরও ফলপ্রসূ হবে যদি গোঁড়া ধর্মীয় নেতা ও সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ‘আজাদি’ দাবির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা সমাজের সব অংশে চারিত হয়, যদি পুরুষতন্ত্রের আগল সরিয়ে মুসলিম নারীদের এগিয়ে আসার এই সূচনা তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি পায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন