একা রামে রক্ষা নাই, কৃষ্ণ দোসর— উত্তরপ্রদেশবাসীরা নিশ্চয়ই ইহাই ভাবিতেছেন। তাঁহাদের রাজ্য রাজনীতি তো বেশ কিছু কাল ধরিয়া ভয়ানক রকম রাম-ময়। এ বার যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে সেই রাম-রাজনীতি চর্চার সহিত পাল্লা দিতে হাজির হইল মুলায়ম সিংহ যাদবের কৃষ্ণভজনা। এটাওয়া-র যাদবকুলতিলক মহোৎসাহে ঘোষণা করিয়াছেন, রাম যত বড় দেবতা হউন না কেন, তাঁহার দেবতা কৃষ্ণ আরও ‘বড়’, আরও জনপ্রিয়, আরও বহুধাবিস্তৃত ও বহুস্বীকৃত তাঁহার দেবপ্রতিভা। একটি পরিষ্কার সাংখ্য হিসাব ধরিয়া দিয়াছেন তিনি। রামের আরাধনা হয় কেবল উত্তর ভারতের সীমিত কতকগুলি অঞ্চলে। আর কৃষ্ণ? উত্তর ভারতে কৃষ্ণভক্তির যতখানি রমরমা, দক্ষিণেও স্থানে স্থানে তাঁহার সন্দেহাতীত গ্রহণযোগ্যতা, আর ভারতের বাহিরেও বিস্তীর্ণ বিশ্বপৃথিবীতে তাঁহার বিপুল ভজনপূজন। অর্থাৎ রামের পক্ষে কৃষ্ণের সহিত আঁটিয়া উঠিবার কোনও সম্ভাবনাই নাই। কিছু কাল আগেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার যখন রামের এক শত মিটার উচ্চ মূর্তি নির্মাণের প্রস্তাব আনিয়াছিলেন, মুলায়ম সিংহ সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা চালে কৃষ্ণের পঞ্চাশ মিটার উচ্চ মূর্তির কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেই দ্বন্দ্ব এ বার আরও বহু দূর আগাইয়া গেল। মুলায়ম প্রমাণ করিলেন, ভারতে প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র কী ভাবে প্রতিযোগিতামূলক ধর্মতন্ত্রের বিকাশ ঘটাইতে সক্ষম।
রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অনেকে বলিতেছেন, শেষে মুলায়মও! তাঁহাদের ইঙ্গিতের অভিমুখ, স্পষ্টতই নরম হিন্দুত্ব। অর্থাৎ বিজেপির হিন্দুত্ব-অ্যাজেন্ডার মোকাবিলা করিতে গিয়া অতীতে কংগ্রেসও যে ভাবে নরম হিন্দুত্বের ফাঁদে ডুবিয়া বসিয়াছে, এ বার সমাজবাদী পার্টিও তাহাই করিতেছে। এত দিন অবধি রাজনীতির আলোচনায়, কর্মকাণ্ডে, স্লোগানে মুলায়ম সিংহ-সহ সমাজবাদী পার্টির নেতারা ধর্মের উচ্চারণ করিতেন না, এবং তাহা না করিতে করিতে নিজেদের জন্য মুসলিম-ভোটাভিলাষী, মুসলিম-তোষণপন্থী ইত্যাদি ‘দুর্নাম’ও জুটাইতেন। মুলায়ম সিংহের দলের একটি বড় সমর্থন মুসলিম সমাজ হইতে আসে, সুতরাং তোষণ হউক আর না হউক, তাঁহাদের পক্ষে হিন্দু দেবদেবীদের কথা তুলিবার হেতুও ছিল না। দেবদেবীদের এড়াইয়া রাজনীতি করাকে যদি এ দেশে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ না বলিয়া মুসলিমতোষণকারী বলাই সাব্যস্ত হয়, তবে বলিতে হয় মুলায়মও সেই দোষে দোষী ছিলেন! সে ক্ষেত্রে তাঁহার আকস্মিক অবস্থান পরিবর্তনও এক অর্থে নরম হিন্দুত্বে অবগাহন ধরিয়া লওয়াই সাব্যস্ত। তবে, ঘটনাটিকে যদি বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখা যায়, তবে মুলায়মের দিকপরিবর্তনের মধ্যে গণতন্ত্র-রাজনীতির একটি সংকট ধরা পড়িতে পারে। শাসক সংস্কৃতি কী ভাবে দেশের সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে লক্ষণীয় বদল আনে, কী ভাবে ‘ডমিন্যান্স’-এর ধাক্কায় ‘হেজেমনি’ ক্রমশ বিস্তার পায়, বর্তমান ভারত তাহার হাতে-গরম উদাহরণ। কৃষ্ণ তো সত্যই যাদবকুলের ঐতিহ্য-দেবতা, লালুপ্রসাদের পুত্ররাও দুর্নীতি মামলায় ঘায়েল হইয়া বৃন্দাবনের দিকে তীর্থযাত্রায় বাহির হইয়া পড়েন। অন্যান্য দলও যদি এখন অন্যান্য দেবদেবীর শরণে লইতে ব্যস্তসমস্ত হইয়া বাহির হন, বিস্ময়ের কিছু নাই।