ভিন্নমত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে প্রতিবাদীরা। কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১৬। পিটিআই
নো ট বাতিলের পর দু’মাস কেটে গেল, অবস্থা এখনও স্বাভাবিক হল না। ইতিমধ্যে নোটের লাইনে অপেক্ষা করতে গিয়ে একশোর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠেছে, নগদের অভাবে চাষবাসের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বারেবারে তাদের অবস্থান পাল্টাবার ফলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে, এবং সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ও আয়বৃদ্ধির হার একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। কেউ জানে না, আরও কতগুলো দু’মাস কাটলে অবস্থা স্বাভাবিক হবে।
যে-নগদহীন অর্থব্যবস্থার কথা প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো বড়লোক দেশে তার উপকারিতা থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশের পরিকাঠামোতে সেটা চালাতে গেলে যে দেশের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হবে আর সাধারণ মানুষ যে অশেষ দুঃখকষ্টে পড়বে সেটা অর্থনীতিবিদরা বার বার বলেছেন। বাস্তবেও তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রীর না বোঝার কথা নয়। তা হলে কোন অজ্ঞাত কারণে তিনি নোট বাতিলের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? বিশেষ করে সামনেই উত্তরপ্রদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের নির্বাচন। গরিব মানুষ কষ্ট পেলে তারা কি প্রধানমন্ত্রীর দলকে ভোট দেবে?
প্রধানমন্ত্রী কতটা অর্থনীতি বোঝেন বা সাধারণ মানুষের অবস্থা নিয়ে তাঁর কতটা উদ্বেগ আছে সে-ব্যাপারে আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বোধ বা বিচারশক্তি বস্তুতই প্রশ্নের অতীত। তাই রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে আপাতদৃষ্টিতে একটা ধাঁধা মনে হতেই পারে, যেহেতু এই সিদ্ধান্ত অসংখ্য ভোটারকে অসুবিধেয় ফেলেছে। কিন্তু কোনও কোনও ব্যাখ্যাতা একেবারে উল্টো কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির পক্ষে মারাত্মক হলেও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির দিক থেকে একেবারে ওস্তাদের মার। এই ব্যাখ্যার সমর্থনে মহারাষ্ট্র, গুজরাত এবং চণ্ডীগড়ের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল করে বোঝা দরকার।
প্রধানমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সমর্থক অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে নোট বাতিলের সমর্থনে এক উদ্ভট যুক্তি খাড়া করেছেন। তিনি বলছেন, পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হওয়ার ফলে বড়লোকরা তাদের অঘোষিত নগদ টাকা গরিবদের নামে জমা করবে এবং এই কাজ করার জন্য তারা গরিবদের তিরিশ শতাংশ কমিশনও দেবে, যেহেতু নিজের আয় হিসেবে ঘোষণা করলে বড়লোককে তিরিশ শতাংশ আয়করই দিতে হত। এর ফলে আয়ের একটা পুনর্বণ্টন ঘটবে এবং অসংখ্য গরিব মানুষ ক্ষমতাসীন সরকারকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে। দুটো কারণে উদ্ভট এই যুক্তি। প্রথমত, বড়লোকের সঙ্গে দর-কষাকষিতে গরিব চিরকালই অপারগ। বড়লোকের এক লাখ কালো টাকা সাদা করে দিলে গরিবের কপালে বড়জোর দু’পাঁচ হাজার জুটতে পারে, তিরিশ হাজার নয়। অর্থাৎ এখানে খুব বড় আকারের পুনর্বণ্টনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। দ্বিতীয়ত, যদি এই ভাবে কিছুটা পুনর্বণ্টন হয়েও থাকে, সেটা আদৌ অভিপ্রেত নয়, যেহেতু কালো টাকা উদ্ধারের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
নোট-বাতিলের রাজনীতিটা বোঝার জন্য আর একটু গভীরে যেতে হবে। আধুনিক গণতন্ত্রে ভোটে জেতার জন্য দু’টো জিনিস দরকার— নির্বাচনে খরচ করার মতো যথেষ্ট অর্থ আর খানিকটা স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন। আমাদের বিশ্বাস, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে দুটি ব্যাপারেই নোট-বাতিলের সিদ্ধান্ত তাদের সাহায্য করবে।
প্রথমে নির্বাচনের খরচের ব্যাপারটা বোঝা যাক। ভারতের মতো বিরাট দেশে নির্বাচন লড়তে গেলে বিস্তর খরচ করতে হয়, তার সিংহভাগ আসে বেসরকারি উদ্যোগপতিদের থেকে। উদ্যোগপতিদের মধ্যে ছোট-বড় নানা রকমফের আছে। বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলকে ছোট-বড় সবাই সাহায্য করতে চাইবে। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলির দিকে বড় উদ্যোগপতিদের ততটা নজর পড়ার কথা নয়, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটি যদি সর্বভারতীয় ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে থাকে। অর্থাৎ আঞ্চলিক দলগুলিকে নির্বাচনের টাকা তোলার জন্য মূলত আঞ্চলিক উদ্যোগপতিদের ওপর নির্ভর করতে হয় যাদের ব্যবসার আয়তন ছোট থেকে মাঝারি মাপের। এটা পরিষ্কার যে, নগদ বাতিলের সিদ্ধান্ত ছোট ও মাঝারি ব্যবসাকেই সরাসরি আঘাত করেছে; বড় ব্যবসার, অন্তত সরাসরি, তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। ফলে আশঙ্কা হয়, আঞ্চলিক দলগুলি কিছু দিন নির্বাচনের খরচ জোগাড় করতে অসুবিধায় পড়বে। এই অসুবিধে বিজেপির হচ্ছে না, যেহেতু সত্যিকারের বড় ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে পুরোদস্তুর রয়েছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চাইছে বিজেপি।
কেউ কেউ বলতে পারেন, বিজেপির মূল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও তো একটি সর্বভারতীয় দল। অতএব তাদের ওপরেও নিশ্চয় বড় ব্যবসায়ীদের সুনজর আছে। নোট বাতিলের মাধ্যমে আঞ্চলিক দলগুলিকে প্যাঁচে ফেললেও বিজেপি তাদের মূল প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের তো কোনও ক্ষতি করতে পারছে না। তা হলে আর লাভ কী হল? এর উত্তরে বলা যায়, সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গেছে জাতীয় কংগ্রেস দল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ক্রমশই আঞ্চলিক দলগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, বিজেপির মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ক্ষমতা ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। এই অবস্থায় আঞ্চলিক দলগুলির ডানা ছেঁটে দিতে পারলে কংগ্রেসের ক্ষমতাও রীতিমত সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। বিজেপি ভাবছে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এই লক্ষ্যে তাদের অনেকটা এগিয়ে রাখবে।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থনের। নোট বাতিলের ফলে নগদের সঙ্কট যখন তুঙ্গে, ব্যাঙ্ক-এটিএম-এর সামনে যখন ভোর থেকে সর্পিল লাইন, শহরে-গ্রামে-মফস্সলে যখন অশক্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখনও কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল, সাধারণ গরিব মানুষের কেউ কেউ, হাজার অসুবিধে সত্ত্বেও, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে। কারণটা মনস্তাত্ত্বিক। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির তত্ত্ব-টত্ব বোঝে না, শুধু দেখেছে চার দিকে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি। দেখেছে, দুর্নীতি করে, গুন্ডামি করে, লোক ঠকিয়ে তার আশেপাশে কিছু জঘন্য লোক হাতে মোটা সোনার চেন বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনতলা বাড়ি, দামি গাড়ি হাঁকিয়ে তারই ওপর চোটপাট করছে। এটা সারা ভারতের চিত্র, এটাই বাস্তব। যে সব বিরাট বিরাট কালোবাজারি বিদেশে টাকা রাখে, বিলাসবহুল খামারবাড়ি কেনে, প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে, সাধারণ মানুষ তাদের চেনে না। তাই তাদের ওপর সাধারণ মানুষের ততটা রাগ নেই। তার যত রাগ তার আশেপাশে যে সব ছোট ও মাঝারি দুর্নীতিবাজ আছে তাদের ওপর।
তাই নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত যে কালো টাকার রাঘব বোয়ালদের ছুঁতেও পারল না, তা নিয়ে গরিবের মাথাব্যথা নেই। তার শুধু এই কথা ভেবে ভাল লাগছে যে, আশেপাশে যে চোর-ডাকাতগুলো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা এ বার বিপদে পড়ল। সিনেমার শেষ দৃশ্যে ভিলেন মার খেলে দর্শকের যেমন ভাল লাগে, এটা অনেকটা সেই ধরনের ভাল লাগা। তা ছাড়া টাকাওয়ালাদের প্রতি গরিবদের একটা স্বাভাবিক বিদ্বেষ আছে। নগদ বাতিল হলে যাদের টাকা আছে তারাই জব্দ হবে— এই সরল যুক্তিতে কিছু গরিব মানুষ নিশ্চয় নগদ বাতিলের সিদ্ধান্তকে প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। গরিব মানুষের এই স্বাভাবিক আবেগকে প্রধানমন্ত্রী কাজে লাগাচ্ছেন, গরিব মানুষের পরিত্রাতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন। সত্যি সত্যি কালোবাজারিরা কতটা জব্দ হল গরিব মানুষ তার খবর রাখে না, এ-নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও খুব একটা উতলা হচ্ছেন বলে মনে হয় না। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত মূলত একটা রাজনৈতিক কৌশল।
কিন্তু মানুষের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাটা তো ঠিক দর্শকের আসনে বসে সিনেমা দেখার মতো নয়। সিনেমার পর্দায় দুষ্টু লোক আগুনে পুড়ে গেলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে বসে তা দিব্যি উপভোগ করা যায়। কিন্তু সেই আগুনের আঁচ দর্শকের নিজের গায়ে এসে লাগলে দুষ্টের দমন সে কতটা উপভোগ করবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমরা নিশ্চিত, অর্থনীতির ওপর থেকে নোট বাতিলের কুপ্রভাব সহজে যাবে না। ফলে যে সব মানুষ এখন গ্যালারিতে বসে প্রধানমন্ত্রীকে বাহবা দিচ্ছেন, আজ না হোক কাল মন্দা-আক্রান্ত অর্থনীতির আঁচ তাঁদের গায়েও এসে লাগবে। তখনও কি তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবেন?
একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নির্বাচনের পিছনে যতই অর্থব্যয় করা হোক না কেন, মোটের ওপর জনসমর্থন না পাওয়া গেলে কোনও দলই নির্বাচনে জিততে পারে না। সে দিক থেকে দেখতে গেলে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে যথেষ্ট রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারটা রাজনীতিবিদ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর পূর্বসূরি মনমোহন সিংহ কিংবা অটলবিহারী বাজপেয়ীর তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর বিশ্বাস। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ ভাবে দেশ শাসন তাঁর ধাতে নেই। শত্রুকে সরাসরি আক্রমণ করে ধরাশায়ী করার মধ্যেই তিনি রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান, যেমন গুজরাতে পেয়েছিলেন। এই আক্রমণে যে ঝুঁকি আছে তা নিতে তিনি পিছপা নন। তাঁর আক্রমণের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাজনীতিতে তুলনায় অনভিজ্ঞ রাহুল গান্ধীর আছে বলে মনে হয় না। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁর মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখেন। বিজেপিও তাঁকেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক