এক সময় ছিল, যখন শীতের আনাজের জন্য সত্যই শীত প়়ড়িবার অপেক্ষায় থাকিতে হইত। এখন বৈশাখেও ফুলকপি অঢেল। দেশপ্রেম বস্তুটিও তেমনই হইয়াছে। আগে জানুয়ারি আর অগস্টের দুইটি তারিখকে কেন্দ্র করিয়া দেশপ্রেমের জোয়ার আসিত। এখন, ২০১৪ সালের পর, সম্বৎসরই দেশপ্রেমের জোগান অব্যাহত। তবুও, শীতের ফুলকপির ন্যায় অগস্টের দেশপ্রেমেও খানিক বাড়তি স্বাদ পাওয়া যায়, ভোজনরসিক বা দেশভক্ত মাত্রেই স্বীকার করিবেন। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিকা পাঠাইয়া দেশপ্রেম জাগাইতে সচেষ্ট হইয়াছে। দেশের সর্বত্র ‘দেশভক্তি’-র সুপবন বহাইয়া দেওয়ার জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রপাঠ জানাইয়া দিয়াছেন, তিনি কেন্দ্রের ‘পরামর্শ’ মানিতে নারাজ। তবে, সব রাজ্য সরকার তাঁহার মতের শরিক নহে। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার স্কুলে স্কুলে নির্দেশিকা পাঠাইয়াছে। মাদ্রাসাগুলির উপর বাড়তি হুকুম, কী ভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হইল, তাহার ভিডিয়ো তুলিয়া রাজ্য সরকারের নিকট জমা করিতে হইবে। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চৌহানও পিছাইয়া নাই। মাদ্রাসাগুলিকে আদেশ দিয়াছেন, ১৫ তারিখ জাতীয় পতাকা তুলিতেই হইবে। রাষ্ট্রীয় ডান্ডা দেখাইয়া দেশপ্রেম জাগাইয়া তুলিবার এমন প্রয়াস স্বাধীন ভারত গত ৭০ বৎসরে দেখে নাই। দেশ বদলাইতেছে বটে।
মাদ্রাসাগুলিকে কেন বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করিতে হয়, কেন তাহাদের জন্য প্রমাণ পাঠাইবার ফরমান জারি করিতে হয়, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে সেই প্রশ্ন তোলা নেহাত অবান্তর। ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-টি নাগপুরের পাঠ্যপুস্তকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এবং, তাহার মূল প্রতিপাদ্য, ভারত নামক রাষ্ট্রের একটিই জাতি আছে— তাহা হিন্দু জাতি। অতএব, ভারতে মুসলমানরা ‘অপর’, এই জাতি-রাষ্ট্রের শরিক নহে। কাজেই, তাহারা ভারতে থাকিতে চাহিলে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়া থাকিতে হইবে বইকি। দেশ কাহাকে বলে, সংঘ পরিবারের সেই সংজ্ঞাটি আপাতত বিজেপির ভারত নির্মাণের প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কাজেই, মুসলমানদের উপায়ান্তর নাই। জলে বাস করিয়া কুমিরের সহিত যদিও বা বিবাদ করা চলে, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথকে ঘাঁটাইবার সাহস করা মুশকিল। ইহা দেশপ্রেম নহে, নিতান্তই মুসলমান-বিদ্বেষ। এক দিকে গোরক্ষক বাহিনীর সন্ত্রাস, আর অন্য দিকে ভারতের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ার রাষ্ট্রীয় দাবি— উভয় প্রান্ত হইতে ভারতীয় মুসলমানদের পরিসরটিকে সংকীর্ণতর করিয়া তুলিবার চেষ্টা চলিতেছে। যে স্বাধীন রাষ্ট্রকে উদ্যাপন করিতে সরকার এমন মরিয়া, তাহার রচয়িতারা সংখ্যালঘুদের প্রতি এই বিদ্বেষকে সর্বান্তকরণে পিছনে ফেলিয়া আসিতে চাহিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীরা যে ভারতকে উদ্যাপন করিতে চাহেন, তাহা গাঁধীর নহে, নেহরুর নহে, অম্বেডকরের নহে। সেই ভারত গোলওয়ালকরের, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের, সাভারকরের।
‘ভারত’ নামক ধারণাটিকে নরেন্দ্র মোদীরা বদলাইয়া ফেলিতে চাহেন। সেই কাজে তাঁহাদের প্রধান আয়ুধ ‘দেশপ্রেম’। অথবা, তাঁহারা যাহাকে দেশপ্রেম বলিয়া চালাইতে চাহেন, সেই খণ্ডদর্শন। যে কোনও বিদ্বেষের গায়েই এক বার জাতীয়তাবাদের নামাবলি জড়াইয়া দিতে পারিলে বহু প্রশ্ন এড়াইয়া যাওয়া চলে। স্বাধীনতা দিবসে ‘বন্দে মাতরম্’ গাহিবার হুকুম কেহ অমান্য করিলে সেই আপত্তির কারণগুলি আর বিশ্লেষণের প্রয়োজনই হয় না— তাহাকে দেশের বিরোধিতা হিসাবে দাগাইয়া দেওয়া যায়। ঠিক এই কারণেই জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলি বিপজ্জনক, এবং সেগুলিকে প্রশ্ন করা দরকার। দেশ নামক বস্তুটি যে তাঁহাদের বিদ্বেষের উপর ধোঁকার টাটি হইবার জন্য নহে, এই কথাটি নাগপুরের কর্তাদের বুঝাইয়া দেওয়া প্রয়োজন।