জামাল মোমিনদের জন্য কোনও সুশীল সমাজ নেই

রয়েছে শুধুই উপেক্ষা

কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। চাইলেই মাইল দশেক পায়ে হেঁটে সাতচল্লিশে কাঁচা দাগের সীমান্ত পার করে আমাদের পূর্বপুরুষ খুব সহজেই ও পারে রোহনপুর, গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহি চলে যেতে পারতেন। যাননি।

Advertisement

শাহনওয়াজ আলি রায়হান

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share:

হাওড়া থেকে মালদাগামী ট্রেনের কামরায় বসে দিনমজুর জামাল মোমিন যে ভাষায় কথা বলে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করছিলেন, ভুল উত্তর দিয়ে চড় খাচ্ছিলেন বা রাজস্থানের রাজসমুন্দে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারাবার ঠিক আগের মুহূর্তে ভিন দেশে পাড়ি দেওয়া এ রাজ্যের শ্রমিক আফরাজুল খান তাঁর হত্যাকারী শম্ভু রেগারের কোপের আঘাতে যে ভাবে ‘আগ্গে-মাগ্গে’ করে আর্তনাদ করছিলেন— বাংলা ভাষার এই উপভাষাগুলো আমার কাছে শৈশব থেকেই চেনা। যেমন শৈশব থেকেই শুনে এসেছি কালিয়াচক মানেই নাকি কথায় কথায় পিস্তল, ক্রিকেটে পাকিস্তানের সমর্থক, আফিম চাষ, সীমান্ত-চোরাচালান আরও কত কী! কালিয়াচকে কোনও ভাল স্কুল ছিল না। এখনও নেই। দূরে যে অপেক্ষাকৃত ভাল স্কুলে পড়তে যেতাম সেখানেও কিছু বদমায়েশি করলে বা না করলেও বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের কাছ থেকে ‘কালিয়া’ নামটা শুনতে হতো। মালদা শহর হোক বা কলকাতা, বাসে-ট্রেনে কোথাও গেলে পার্শ্বযাত্রীর সঙ্গে আলাপের সময় বাড়ি কোথায় এই প্রশ্নের উত্তরে কালিয়াচক বলতে আড়ষ্ট লাগত। পাছে উনিও না ভেবে বসেন, আমরা কথায় কথায় গাল দিই, খুন করি! নিজ এলাকার বাইরে কোথাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেও একই অস্বস্তি। এখনও আমার ফেসবুক প্রোফাইলে বাসস্থানের কলামে মালদা লেখা, কালিয়াচক নয়! উত্তরপ্রদেশের আজমগড় ‘আতঙ্কগড়’ তকমা পাওয়ার অনেক আগে থেকেই কালিয়াচক জনমানসে নানা সাধারণীকরণের শিকার।

Advertisement

কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। চাইলেই মাইল দশেক পায়ে হেঁটে সাতচল্লিশে কাঁচা দাগের সীমান্ত পার করে আমাদের পূর্বপুরুষ খুব সহজেই ও পারে রোহনপুর, গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহি চলে যেতে পারতেন। যাননি। শোনা যায় স্বাধীনতার তিন দিন পরেও আমাদের এলাকায় পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল। কারণ তখনও পরিষ্কার হয়নি মালদা কার ভাগে গিয়েছে। পরে যখন একবার পরিষ্কার হয়ে গেল ভারতের দিকেই, তার পর থেকেই স্বদেশ প্রসঙ্গে আর কোনও প্রশ্ন কালিয়াচকবাসীর মনে দানা বাঁধেনি। মালদা তথা অবিভক্ত দিনাজপুরের নানা জায়গায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ও পার থেকে লোকজন এসে বসবাস শুরু করেছে, এ পারের লোকজনও ও পারে গিয়েছে। কিন্তু কালিয়াচকবাসী কোথাও যায়নি। গঙ্গা-ভাঙনে বার বার আমাদের নিজেদেরই গ্রামের ভূগোল পাল্টে গিয়েছে। তলিয়ে গিয়েছে কালিয়াচক থানার অসংখ্য গ্রাম। তবু কখনও তলায়নি আমাদের স্বদেশপ্রেম। আমাদের স্বাধীনতা দিবস, ছাব্বিশে জানুয়ারি, পঁচিশে বৈশাখ সব কিছু শেখা ওই কালিয়াচকেই। কালিয়াচকের বেশ কিছু মুসলমান অধিবাসী খোট্টা ভাষায় কথা বলেন। তার জন্য তাঁরা না নিজেদের কখনও বিহারি ভাবেন, না উর্দুভাষী। ছেলেমেয়েকে বাংলা মাধ্যম ইস্কুলেই পড়ান, দোকানের সাইনবোর্ড থেকে বিয়ের কার্ড সব বাংলাতেই লেখেন। অথচ এই বাংলায় থেকেও আজ কালিয়াচক যেন ভারতে না, জামাল মোমিনের প্রধানমন্ত্রীর নাম তাই খুব সহজেই ‘নওয়াজ শরিফ’ দেগে দেওয়া যায়। যদিও ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটিতে যে ব্যক্তিটি কুইজ়ের ভঙ্গিতে জামাল মোমিনের জাতীয়তাবাদের মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছেন, উত্তর দিতে না পারলে থাপ্পড় মারছেন তিনি নিজেও হয়তো জানেন না শত্রু দেশের মসনদে নওয়াজ শরিফ আর নেই! আসলে মালদা টাউন ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার হোক বা হাটেবাজারে এক্সপ্রেস— রেল সফরের সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতির শিকার মুসলিম যাত্রীদের আগেও হতে হয়েছে। এখন হয়তো একটু বেশি উৎকট ভাবে হচ্ছে বা হবে এই যা পার্থক্য। শৈশবে কলকাতা থেকে ফরাক্কা (কারণ বেশিরভাগ ট্রেন কালিয়াচকের খালতিপুর স্টেশনে থামে না) আসার পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে প্রথম শুনেছিলাম সেই বহুল প্রচলিত ‘‘ও তুমি মুসলমান, আমি তো ভেবেছিলাম বাঙালি’’। সংরক্ষিত কামরায় লোকাল যাত্রী চেপে যাওয়া, সিট দখল করা— ও সব ইউপি-বিহারের সংস্কৃতি, বাংলাতে হয় না ভেবে যাঁরা আত্মতৃপ্তি পান তাঁদের কাছে অনুরোধ একটি বার শিয়ালদা থেকে নৈহাটি অবধি হাটেবাজারে এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় ঢুঁ মারুন। দেখবেন অধিকাংশ যাত্রী মালদা, পূর্ণিয়া, কাটিহার, বারাউনি এলাকার। শিয়ালদা-নৈহাটি লাইনের অফিসফেরত নিত্যযাত্রীরা তাঁদের সিট দখল করে বসে আছেন, তাস খেলছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। প্রতিবাদ করলে তাঁদের আঞ্চলিকতা তুলে বকা দিচ্ছেন। সহযাত্রী আব্বা-চাচা-আম্মা কারও দাড়ি-টুপি-হিজাব দেখে ধর্মপরিচয় চিহ্নিত করতে পারলেই উড়ে আসছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে দিদির সংখ্যালঘু তোষণজনিত কাজ নিয়ে নানা বক্রোক্তি। যেন এ সব কিছুর জন্য কলকাতা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরা ওই রিজার্ভেশন টিকিটের ‘দাদা সিটটা আমার’ বা ‘একটু চেপে বসুন’ বলা যাত্রীই দায়ী! জামাল মোমিনও ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন, আর হাতছাড়া হওয়া জানালার ধারের সিটটাও তাঁরই ছিল। মোদী-পরবর্তী ভারতে যদিও এ হেন ঘটনার প্রাবল্য ও হার বেড়েছে তবু জনপরিসরে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে ভারতীয় রেল অনেক দিন ধরেই মুক্তাঞ্চল। একাকী মুসলমান এখানে খুব সহজেই তাঁর ভাষা-শ্রেণি-নাগরিকত্ব সব পরিচয় হারিয়ে শুধুই ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে নিজ স্বদেশ-পরিজন সব কিছু থেকে দূরের একটি ভূখণ্ডের সমার্থক হয়ে যেতে পারেন। নিজভূমে কাজ না পেয়ে ভিন দেশে পাড়ি দেওয়ার যাতনা, তিনশো কিলোমিটার সফর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডাক্তার দেখিয়ে সে দিনই বাড়ি ফেরার ধকল এ সব বোঝার প্রশ্ন ওঠে না। উগ্র স্বদেশপ্রেমের উল্লাসে ট্রেনের কামরা তখন দ্রাস, কারগিল আর সামনের সংখ্যালঘুজনই সেই ‘পাকিস্তান’ যে আশেপাশেই থাকে কিন্তু মোক্ষম সময়ে নাগালে পাওয়া যায় না!

সব দোষ কি তবে নাগপুরের? বিজেপির ক্ষমতায় আসা তো না হয় ঝড়ের তীব্রতা বাড়িয়েছে। কিন্তু দূষিত বাষ্প তো আগেও ছিল। ছিল উপেক্ষা, আমরা-ওরা বিভাজনও। ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বাড়ি ভাড়া না দেওয়া থেকে সাচার রিপোর্ট সবই ছিল। কত কী নিয়েই তো সিনেমা হয় এই বাংলায়। অথচ মধ্যবঙ্গের জ্বলন্ত সমস্যা গঙ্গাভাঙন নিয়ে হয় না কেন? হরিয়ানার গাড়ি কারখানার শ্রমিকদের সমস্যা থেকে বিদর্ভ এলাকার চাষিদের সঙ্কট, ছত্তীসগঢ়ের প্রত্যন্ত গ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস— সব কিছুই তো জায়গা পায় কলকাতার প্রতিবাদ সভায়। মালদা জেলারই জিতু সাঁওতালদের বিদ্রোহ জায়গা পায় সাব-অলটার্ন সিরিজ়ের পাতায়। অথচ আম, রেশম সমৃদ্ধ কালিয়াচকের আফরাজুলরা কাজের খোঁজে কেন রাজস্থান, জামাল মোমিন কেন গুজরাত যান, বা পুরনো দিল্লির অধিকাংশ রিকশাচালক কেন গৌড়বঙ্গের বা আজকাল মালদা-মুর্শিদাবাদের ভিন দেশে পাড়ি জমানো শ্রমিকরা ইদানীং কেরলকেই কেন রাজমিস্ত্রির কাজের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন, দুর্বলের এ সব বিষয় নিয়ে নেই কোনও সবলের অনুসন্ধিৎসা। রয়েছে শুধুই উপেক্ষা, উদাসীনতা বা অজ্ঞতা। আগে কালিয়াচকে আফিম চাষ সত্যি হতো, জাল নোট ছাপা হতো, যতটা বাড়িয়ে বলা হয় ততটা না হলেও দুষ্কৃতীমূলক কর্মে এলাকার একটা শ্রেণি জড়িত এখনও। কিন্তু এগুলির পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ। অথচ আলোচনার সময় শুধুই প্রাধান্য পায় অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয়! জামাল মোমিনদের জন্য তাই কোনও রাজনৈতিক নেতা নেই, সুশীল সমাজ নেই, বিদ্বজ্জন নেই, কাজ নেই, এমনকি নিজ এলাকায় একটা ভাল ডাক্তারও নেই। ভিডিয়োটি যখন সামনে এল, জামাল তত দিনে রুজি-রুটির খোঁজে গুজরাতে, অন্যদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী কালিয়াচক থানায় এফআইআর দায়ের করতে গেলেও পুলিশ গোড়ায় তা নিতে অস্বীকার করে। তাই জামালের এই দেশে একটা প্রধানমন্ত্রী থাকবে এমন আশা ট্রেনের প্রশ্নকারীর পাশাপাশি অন্যদেরও না করাই উচিত। ভালই করেছে সে জাতীয় সঙ্গীত শোনাতে পারলেও প্রধানমন্ত্রীর নাম ভুল বলে। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছে হয়তো এই কারণেই যে সে নামটা বেশি শুনেছে, বা ওটাই জানে। অথবা শুনেছে মমতা নাকি মুসলিমদের জন্য নানা উন্নয়নমূলক কাজ করছেন। যে কাজের কথা কালিয়াচকের অন্যদের মতো সেও শুধুই শুনেছে, এখনও দেখেনি। দেখলে কি কাজ খুঁজতে গুজরাত যায় বোকাটা!

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন