উদ্যাপন: অম্বেডকরের প্রয়াণদিবস পালন আসলে একটি আন্দোলনের লক্ষ্যে শক্তি সংগ্রহ, ঠানে, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮। পিটিআই
বেগমপুরা— সে নাকি এমন এক শহর যেখানে কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় নয়, সকলেই প্রথম, কেননা সকলেই সমান। সেখানে যে কোনও লোক যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, অবাধে ঘুরতে পারে বড় বড় প্রাসাদের অলিন্দে। পঞ্চদশ শতকে কবি রবিদাস তাঁর ‘বেগমপুরা’ কবিতায় এমনই এক জায়গার কথা কল্পনা করেছিলেন। কবিতার কয়েকটি লাইন: ‘‘বলে রবিদাস, এক মুক্তি-পাওয়া চামার/ যারা হাঁটে পাশে তারা বন্ধু আমার।’’ বৈষম্যহীন নাগরিকত্বের এই ধারণাতেই ছিল দলিত আন্দোলনের ভিত্তি। বর্ণব্যবস্থা-বিরোধী তত্ত্বের শিকড় প্রোথিত বেগমপুরার দর্শনে। বাকি কেবল তাকে নির্মাণের কাজটুকু।
বেগমপুরা সত্য হবে, এই প্রত্যয়ের প্রেরণায় মহারাষ্ট্রের অম্বেডকরপন্থীরা বছরে পাঁচটি দিন উদ্যাপন করেন। তার অন্যতম হল, ভীমা-কোরেগাঁওয়ের সম্মেলন। সেখানকার ক্রান্তি বিজয়স্তম্ভে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি স্মরণ করা হয় ১৮১৮ সালের যুদ্ধে পেশোয়াদের পরাজয়কে। তাদের বিপুল বাহিনীকে হারিয়েছিল যে ব্রিটিশ সেনা, তার অধিকাংশ ছিলেন অচ্ছুৎ ‘মাহার’। ১৯২৭ সালে বাবাসাহেব অম্বেডকর কোরেগাঁওয়ে মাহার শহিদদের স্মরণে সম্মেলন শুরু করেন।
এ ছাড়া অম্বেডকরের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণের দিনটি উদ্যাপিত হয় নাগপুরের ‘দীক্ষাভূমি’তে, ১৪ অক্টোবর। প্রতি ২৫ ডিসেম্বর মহাড শহরে পালন করা হয় নারীমুক্তি দিবস। সেখানে সে দিন মনুস্মৃতি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন অম্বেডকর। ডিসেম্বরের ছয় তারিখ মুম্বইয়ের চৈত্যভূমিতে পালিত হয় তাঁর প্রয়াণদিবস। অম্বেডকর জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল, রাজ্যের সব অম্বেডকর মূর্তির সামনে। অম্বেডকরকে ঘিরে প্রতি বছর এই কর্মকাণ্ডে যত পত্রিকা-ইস্তেহার বিলি হয়, যত নাটক বা গান হয়, সবই বেগমপুরা নির্মাণে মানুষের যোগদানের স্বাক্ষর।
মহারাষ্ট্রের প্রাণপুরুষ যে শিবাজি, অম্বেডকর-পন্থীরা তাঁকেও দেখেন অন্য দৃষ্টিতে। হিন্দুত্ববাদীদের রচিত ইতিহাসে শিবাজিকে বরাবর ‘হিন্দু রাজা’ বলে দেখা হয়েছে। অম্বেডকরপন্থী গান এবং গদ্যে কিন্তু তিনি এক জন প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তক, অব্রাহ্মণ শাসক। হিন্দুত্বপন্থীরা এই দাবির মোকাবিলা করেছে হিংসা দিয়ে। ২০১৫ সালে গোবিন্দ পানসারের হত্যা তার একটা দৃষ্টান্ত। ‘শিবাজি কে ছিলেন?’ বইতে পানসারে বলেন, শিবাজিকে আজ ‘গোব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে তুলে ধরা হলেও সেই সময়ে উচ্চবর্ণ হিন্দুর অনেকগুলি গোষ্ঠী তাঁর অধীনতা স্বীকার করতে চায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল।
হিংসার আর একটি দৃষ্টান্ত ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভীমা-কোরেগাঁওয়ের কাছে গোবিন্দ মাহার গায়কোয়াড়ের সমাধির উপর আক্রমণ। লোকশ্রুতি, গোবিন্দ আওরঙ্গজেবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে শিবাজির পুত্র সম্ভাজির শেষকৃত্য করেছিলেন। সেই দিন, এবং পয়লা জানুয়ারি, ২০১৮, ভীমা-কোরেগাঁওতে অম্বেডকরপন্থীদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ চলে। দলিত-বিরোধী হিংসা উস্কানোর জন্য অভিযুক্ত হন হিন্দুত্ববাদী নেতা মনোহর ‘সম্ভাজি’ ভিডে (প্রধানমন্ত্রী মোদী যাঁকে ‘গুরু’ বলে অভিহিত করেছেন) এবং মিলিন্দ একবোটে।
এ বছর পয়লা জানুয়ারি ভীমা-কোরেগাঁওয়ের জমায়েত নিয়ে তাই যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। নানা দলের কিছু নেতা-সহ বহু মানুষকে আগাম গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। নিরাপত্তার কড়া ব্যবস্থাও ছিল। হিংসার আশঙ্কায় ভিড় অবশ্য কম হয়নি, জমায়েত হয়েছিল গত বছরের মতোই, বা তার চাইতেও বড়। শেষ অবধি কোনও অশান্তি হয়নি। কিন্তু হিংসা হতে পারে, সেই সম্ভাবনার ছায়া থাকলই।
এই হিংসাকে প্রধানত নির্বাচনী রাজনীতির সংঘাত বলেই দেখা হয়। ‘বঞ্চিত বহুজন অঘাড়ি’ নামে একটি মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাবাসাহেব অম্বেডকরের পৌত্র প্রকাশ অম্বেডকর। গত বছর ভীমা-কোরেগাঁওয়ের মেলার আগে তিনি বিজেপি-শিবসেনা সরকারকে ‘নয়া পেশোয়া’ বলে চিহ্নিত করে তাকে হারানোর ডাক দেন। ভীমা-কোরেগাঁওয়ে আক্রমণের প্রতিবাদে তিনি মহারাষ্ট্রে বন্ধ করতেও সফল হয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের যে রায় দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অপরাধের সাজাকে নমনীয় করতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরিতেও তিনি সফল। সম্প্রতি তিনি মুসলিমদের একটি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, তার নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসিকে ভোটে জেতানোর জন্য প্রচারও করেছেন। এর ফলে নির্বাচনের জটিল হিসেব আরও জটিল হয়েছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসা আসলে মরাঠা এবং দলিতদের মধ্যে সংঘাত তৈরির চেষ্টা। ওই সময়ে মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে ‘মরাঠা মুক্তি মোর্চা’ নামে অনেকগুলি বিশাল মিছিল বার হয়। প্রথম দিকে দলিত-নির্যাতনে সাজার কঠোরতা কমানোর দাবিও করেন মরাঠারা। কিন্তু পরে সেই দাবি থেকে তাঁরা সরে আসেন, এবং প্রকাশ অম্বেডকর মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের দাবিকে সমর্থন জানান। এই মরাঠা-দলিত ঐক্যে ফাটল ধরলে লাভ হবে হিন্দুত্ববাদীদের। সেই উদ্দেশ্যেই ভীমা-কোরেগাঁওয়ে হিংসা উস্কানো হয়েছিল, মনে করেন অনেকে।
মহারাষ্ট্রের পুলিশ আবার মনে করে, অম্বেডকর অনুগামীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চায় মাওবাদীরা। ভীমা-কোরেগাঁওয়ের সংঘাত তারাই পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছে। হিংসা উস্কানোর অভিযোগে বেশ কিছু শ্রমিক নেতা এবং বামপন্থী শিক্ষক, সংগঠকদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁদের গায়ে ‘আরবান নকশাল’ ছাপ পড়েছে। গোড়ায় কিছু হিন্দুত্ববাদী নেতার বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করে পুলিশ। নমো-নমো করে তদন্ত করে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। একবোটে গ্রেফতার হয়েও জামিনে ছাড়া পান। ভিডের বিরুদ্ধে এখনও অবধি কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। যে দুষ্কৃতীরা ভীমা-কোরেগাঁওয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, গত এক বছরে তাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। যদিও ‘চিরুনি-তল্লাশি’ চালিয়ে পুলিশ বেশ কিছু অম্বেডকরপন্থী তরুণকে গ্রেফতার করেছে। সরকারি কমিশন এখনও সব পক্ষের বক্তব্য শুনছে। তবে যতগুলি স্বতন্ত্র কমিশন সে দিনের ঘটনা খতিয়ে দেখেছে তার প্রতিটির সিদ্ধান্ত, রীতিমতো ষড়যন্ত্র করে সে দিন হামলা চালানো হয়েছিল অম্বেডকরপন্থীদের উপর।
আঘাত হানার এই সংগঠিত চেষ্টা বুঝিয়ে দেয়, অম্বেডকরপন্থী আন্দোলনে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়েছে। অম্বেডকরের স্মরণে পাঁচটি বার্ষিক সমাবেশে যোগদান বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন সমাজগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, নানা রাজ্য থেকে আসা মানুষ যোগ দিচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের নানা এলাকায় বর্ণ-ধর্ম বা অন্যান্য বিভেদকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ-উত্তেজনা ছড়ায় না, এমন নয়। কিন্তু এখনও অবধি তা অম্বেডকরের নামে একত্রিত বিভিন্ন বঞ্চিত গোষ্ঠীর বোঝাপড়ায় ফাটল ধরাতে পারেনি।
নির্বাচনে কার কী লাভ হবে, তা অন্য প্রশ্ন। বাবাসাহেব অম্বেডকর ভারতের ইতিহাস লিখেছিলেন শ্রমণ বিপ্লব এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিবিপ্লবের কাঠামোতে। ভীমা-কোরেগাঁওয়ের উদ্যাপন এবং তার উপর আক্রমণের ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, তারই পুনরাবৃত্তি চলছে।