চরম ব্যস্ততার মুহূর্তেও যে কোনও কর্মসূচিতে হাজির

জ্যোৎস্না রাত। বন্ধুরা সুভাষচন্দ্রকে গান গাইতে বললেন। গঙ্গার বুকে সুভাষ ভরাট উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, “দূরে হের চন্দ্র কিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা...’’। এ গান তাঁর বড় প্রিয়। লিখছেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়সময়টা ১৯১৩ সালে মে মাস। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে    সুভাষচন্দ্র তাঁর বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের নিমন্ত্রণে কৃষ্ণনগর এসেছেন। সম্ভবত সেই প্রথম তাঁর কৃষ্ণনগর আসা। উঠেছেন বন্ধুর বাড়িতেই। ইতিহাসের নদিয়া এবং নবাবি মুর্শিদাবাদের প্রসিদ্ধ স্থানগুলি দেখতে প্রায়ই বেড়িয়ে পড়তেন সুভাষচন্দ্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:০৯
Share:

তাঁর ঘর ছিল গোটা পৃথিবীই। তবু নদিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্য সেই ছাত্রজীবন থেকে। সুভাষচন্দ্র থেকে নেতাজী হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদিয়ার জেলাসদর রাজার শহর কৃষ্ণনগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ। মাঠ-ঘাট থেকে গঙ্গা-জলঙ্গি নদী। পলাশির প্রান্তর থেকে অঞ্জনার তীর। চৈতন্যধাম নবদ্বীপ অথবা অদ্বৈত ভূমি শান্তিপুর হয়ে বাগআঁচড়া কিংবা মহেশগঞ্জ জুড়ে ছিল তার অবাধ বিচরণ। সময়টা ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮। ওই সাড়ে তিন দশকে বারে বারে নদিয়ায় এসেছেন সুভাষচন্দ্র। স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করার প্রাথমিক পর্বে সুভাষচন্দ্রের জীবনে নদিয়ার প্রভাব অকল্পনীয়।

Advertisement

সময়টা ১৯১৩ সালে মে মাস। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে সুভাষচন্দ্র তাঁর বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের নিমন্ত্রণে কৃষ্ণনগর এসেছেন। সম্ভবত সেই প্রথম তাঁর কৃষ্ণনগর আসা। উঠেছেন বন্ধুর বাড়িতেই। ইতিহাসের নদিয়া এবং নবাবি মুর্শিদাবাদের প্রসিদ্ধ স্থানগুলি দেখতে প্রায়ই বেড়িয়ে পড়তেন সুভাষচন্দ্র। সঙ্গে হেমন্তকুমার ছাড়াও থাকতেন সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, যুগলকিশোর আঢ্য, গুরুদাস গুপ্ত প্রমুখ। নদিয়ার পলাশি কিংবা মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের বিভিন্ন ইতিহাসখ্যাত জায়গাগুলির প্রতি আশ্চর্য রকমের টান ছিল সুভাষচন্দ্রের। একদিন নৌকা করে ফিরছেন মুর্শিদাবাদ থেকে। বেশ রাত হয়েছে। বৈশাখি জ্যোৎস্নার রাত। বন্ধুরা সুভাষচন্দ্রকে গান গাইতে বললেন। গান সুভাস নিজেও ভালই গায়। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে সুভাষ ভরাট উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, “দূরে হের চন্দ্র কিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা। ধায় মত্ত হরষে সাগরে পদপদ পরশে। কূলে কূলে করি পরিবেশন মঙ্গলময়ী বরষা, শ্যামধরণী সরসা।” কান্তকবির এ গান ছিল সুভাষচন্দ্রের বড় প্রিয়। অন্য এক দিন সদলবলে নবদ্বীপ এসেছেন সুভাষচন্দ্র। চৈতন্যদেবের স্মৃতি বিজড়িত নবদ্বীপ থেকে নৌকায় ফিরতি পথে স্রোতের উজানে আসতে হয়। জলঙ্গি দিয়ে নৌকা করে ফেরার সময় সকলের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে গুন টানলেন সুভাষচন্দ্র।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর হেমন্ত সরকার কৃষ্ণনগরে শ্রমজীবীদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। মূলত বন্ধুকে এই কাজে সহায়তা করতেই সুদূর কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে আসতেন সুভাষচন্দ্র। নিয়ম করে ওই নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সঙ্গে আসতেন শৈলেন ঘোষ। যিনি পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকায় বসে ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করবেন।

Advertisement

কৃষ্ণনগরে সুভাষের নিয়মিত যাতায়াতের ফলে হেমন্ত সরকার ও তাঁর বন্ধুদের মধ্যে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করল। কৃষ্ণনগরের অঞ্জনা নদী তখনও মরেনি। অঞ্জনার ধারে তাঁরা সমবেত হতেন। সেখানে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হত। থাকত ধর্মের আলোচনাও। কলকাতা থেকে সুভাষ এক এক বার এক এক জনকে নিয়ে যেতেন সেই আলোচনা সভায়। কখনও সুরেশচন্দ্র তো হেমচন্দ্র দত্তগুপ্ত, কখনও আবার হেমচন্দ্র সরকার। এই রকম সময়ে সুভাষচন্দ্র কৃষ্ণনগরের জলঙ্গি নদীতে সাঁতার শিখেছিলেন। এক দিন হেমন্ত সরকার সুভাষকে কথায় কথায় জানান, তাঁর পৈত্রিক বাসস্থান বাগআঁচড়া গ্রামে আলিপুর বোমার মামলার আসামি নিরাপদ রায় থাকেন। তিনি তখন দশ বছর দ্বীপান্তর-দণ্ড ভোগ করে গ্রামে বাস করছেন। বাগআঁচড়া ছিল নিরাপদ রায়েরও পৈত্রিক বাসস্থান। সুভাষচন্দ্র চললেন, আলিপুর বোমা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মানুষটিকে দেখতে। সেই বিপ্লবী সাধক সুভাষচন্দ্রের পরিচয় পেয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। সুভাষের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তিনি যেন বড় হয়ে দেশের কাজ করেন আর কখনও যেন গ্রামকে না ভুলে যান।

এক বার বড়দিনের ছুটিতে সন্ন্যাসী জীবনযাপন করার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গেলেন শান্তিপুর। সেখানে গঙ্গার ধারে জনৈক ভরত পোদ্দারের খালি বাড়িতে শুরু করলেন সন্ন্যাস জীবনের যাবতীয় কৃচ্ছ্বতার অনুশীলন। ইন্দ্রদাস বাবাজী নামে এক তরুণ সন্ন্যাসী সেই সময়ে নদিয়ায় আসেন। সুভাষচন্দ্র এবং হেমন্ত সরকার তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে এই হেমন্ত সরকার ছিলেন সুভাষের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯১২ সালে কটকে হেমন্তর সঙ্গে সুভাষের আলাপ হয়েছিল। সুভাষের সহপাঠী সমবয়সী হেমন্ত পরবর্তী কালে সহকর্মী ও সহযোদ্ধা ছিলেন নেতাজির। তৎকালীন বাংলা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতিষ্ক হেমন্ত ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডান হাত এবং স্বরাজ্য দলের চিফ হুইপ। তিনি নদিয়া কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে।

হেমন্ত সরকার তাঁর ‘সুভাষের সঙ্গে বারো বছর’ বইতে লিখছেন, “কিছু দিন পরেই সুভাষ এল কেষ্টনগরে আমার কাছে। আমাদের বাড়িতে প্রথমে তার স্থান হল না। তাই সুভাষকে নিয়ে নিকাড়ি পাড়ায় ডা: দামোদর চক্রবর্তীর এক বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওই বাড়িটা তখন ছিল একটা মেস বাড়ি। নানা রকম অনিয়মে সুভাষের শরীর তখন ভেঙে পড়েছিল। কৃষ্ণনগরে সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হল। মেস থেকে আমাদের বাড়িতে এনে ওঠালাম।” ওই বইয়ে হেমন্ত সরকার লিখেছেন যে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের এক মেসে তিনি, সুভাষ এবং অন্য বন্ধুরা প্রায়ই যেতেন। সেখানেই তাঁরা বিপ্লবী বাঘাযতীনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়ে ছিলেন।

ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্র ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকেন দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। স্বাভাবিক ভাবেই কমে যায় আগের মতো নদিয়ায় যাতায়াতের সুযোগ। তবু নদিয়ার প্রতি তাঁর ছিল আন্তরিক টান। সেটা বোঝা যায়, চরম ব্যস্ততার মুহূর্তেও যে কোনও কর্মসূচিতে তিনি নদিয়াতে আসবেনই। সেটা সম্ভবত ১৯২৯ সাল। সুভাষচন্দ্র কৃষ্ণনগরে এক বিশেষ ছাত্র-যুব সভায় বক্তৃতা করেন। জায়গাটি ছিল ছুতোরপাড়া। সে সময়ে ওইখানেই ছিল কৃষ্ণনগর অ্যাথলেটিক ক্লাব এবং বিপ্লবী সংগঠন ‘রেড সার্ট ভলান্টিয়ার্স’দের কুচকাওয়াজের মাঠ। ছিল সাধনা লাইব্রেরির কিশোর বিভাগ। সুভাষচন্দ্রের সেই বিশেষ সভায় সকলের প্রবেশ অধিকার ছিল না। যাতে অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে না পড়ে, তার জন্য সভামণ্ডপটি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রেড সার্ট ভলান্টিয়ার্সদের।

সুভাষচন্দ্রকে ১৯৩০ সালের ২ নভেম্বর, কৃষ্ণনগর পুরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রদান করা হয় মানপত্র। এর বছরখানেক পর সুভাষচন্দ্র ফের কৃষ্ণনগরে আসেন। নদিয়াতে সুভাষচন্দ্র শেষবার আসেন ১৯৩৮ সালে। তখন তিনি সকলের নেতাজী। নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্বপাড়ে মহেশগঞ্জে বিমানে করে নামেন। মহেশগঞ্জের পালচৌধুরীদের মাঠে তাঁর বিমান নামলে একদল স্বেচ্ছাসেবক তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান। এঁরা নদিয়ার সুভাষ অনুগামী স্বেচ্ছাসেবক। এখান থেকে তিনি নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলায় এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। শহর নবদ্বীপ যেন ওই জনসভায় ভেঙে পড়েছিল।

প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভাবধারার এক নায়ক ছিলেন সুভাষচন্দ্র। আর কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া ছিল সুভাষচন্দ্রের তারুণ্যের লীলাভূমি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন