অলীক অর্জনের ফাঁদ

আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, সমস্যা বুঝি স্মার্টফোনের। তাহার সম্যক ব্যবহার না জানাই বুঝি বিপদ ডাকিয়া আনিতেছে। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল নহে। প্রযুক্তির যুক্তি বলিবে, স্মার্টফোনের জোরে মানবসভ্যতা অতি দ্রুত অগ্রসর হইতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

দিকে দিকে বার্তা রটিয়া গিয়াছে। মোমো আসিবে, খেলিবে এবং বধ করিবে। কোনও এক ব্রাহ্মমুহূর্তে স্মার্টফোনের পর্দায় ভাসিয়া উঠিবে মোমো নামক এক ভয়ানক মূর্তির ছবি এবং তাহার সহিত গেম খেলিবার আমন্ত্রণ। প্ররোচিত হইয়া আমন্ত্রণ গ্রহণ করিলে গেমের একটি পর্যায়ে খেলোয়াড়কে প্রাণনাশের হুমকি দিবে মোমো। মনোবিদরা জানাইয়াছেন, নিছক কৌতূহলের বশেই নানা ফাঁদে পা ফেলিতেছে অল্পবয়সিরা। আবদার পূরণ করিতে খুব কম বয়সেই তাহাদের হাতে স্মার্টফোন তুলিয়া দেন অভিভাবকগণ। তবে সেই ফোন লইয়া সন্তান কী কৌতূহল মিটাইতেছে, কী ভাবে তাহাকে ব্যবহার করিতেছে, সেই দিকে তাঁহাদের মনোযোগ কম। বহু অভিভাবক ফোনের ব্যবহার সম্পর্কেও সম্যক অবহিত নহেন। এই রূপ ছিদ্রপথেই প্রবেশ করিতেছে মোমোর ন্যায় বিপদ। কিছু কাল পূর্বে ইহারই নাম ছিল ব্লু হোয়েল। এখন হইয়াছে মোমো। আগামী কাল বা তাহার পরের দিন হয়তো অন্য কোনও নামে আসিবে আরও কোনও মারণ খেলা।

Advertisement

আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, সমস্যা বুঝি স্মার্টফোনের। তাহার সম্যক ব্যবহার না জানাই বুঝি বিপদ ডাকিয়া আনিতেছে। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল নহে। প্রযুক্তির যুক্তি বলিবে, স্মার্টফোনের জোরে মানবসভ্যতা অতি দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। কয়টিমাত্র স্পর্শে জগতের প্রায় সমস্ত কর্মই সম্পাদন করিতে পারে এই আজব কল। এক কালে পৃথক কাজের জন্য পৃথক যন্ত্র ব্যবহৃত হইত। যথা, সময় দেখিতে ঘড়ি কিংবা চিত্রগ্রহণে ক্যামেরা। স্মার্টফোন একই অঙ্গে ধারণ করিয়া আছে বিবিধ যন্ত্র। অতএব, প্রতিটি মানুষের অবিচ্ছেদ্য জীবনসঙ্গীও হইয়া উঠিয়াছে পাঁচ ইঞ্চির যন্ত্রটি। এবং, মানুষ ক্রমে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে তাহার পরিপার্শ্ব হইতে, মনুষ্যসঙ্গ হইতে। সমস্যাটি এইখানেই— স্মার্টফোনে নহে, তাহার তৈরি করিয়া দেওয়া বিচ্ছিন্নতায়।

সেই বিচ্ছিন্নতা উভয় দিকেই কাটে। পূর্বে, যখন বন্ধু বলিতে রক্তমাংসের সহমানুষ বুঝাইত, তখন কেহ বিপথগামী হইলে বহু ক্ষেত্রেই বন্ধুরা তাহাকে ফিরাইয়া আনিতে পারিত। আর কিছু না হউক, কোনও না কোনও বন্ধু অভিভাবকের নিকট সংবাদটি পৌঁছাইয়া দেওয়ার কাজটি করিত। ভার্চুয়াল বা অলীক বন্ধুদের সেই দায় নাই। অন্য দিকে, স্মার্টফোনবাহিত সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের অলীক বন্ধুদের নিকট নিজের একটি ভাবমূর্তি তৈরি করিবার তাগিদ এখন প্রবল। কেহ রন্ধনপটু হিসাবে খ্যাতি চাহে, কেহ বাইকবাহন মাচো হইতে প্রয়াসী। বহু ক্ষেত্রেই, নিজের বাস্তব সত্তা হইতে ভার্চুয়াল সত্তার দূরত্ব কার্যত অলঙ্ঘ্য। তখনই নিজেকে প্রমাণ করিবার তাগিদ জন্মিতে থাকে। বন্ধুদের নিকট, নিজের নিকটও বটে। বাস্তববিচ্ছিন্ন কিশোর-তরুণরা বুঝিয়া উঠিতে পারে না, কোন পথে তাহা সম্ভব। তখনই মোমো বা ব্লু হোয়েল নামক খেলাগুলি আকর্ষক হইয়া উঠিতে থাকে। একের পর এক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করিবার মধ্যে যে জয়ের অনুভূতি আছে, তাহা এই দুর্ভাগা কিশোরকিশোরীদের একটি অর্জনের বোধ আনিয়া দেয়। হায়, সেই বোধও নেহাত অলীক। শেষ অবধি পড়িয়া থাকে একটি ক্ষতবিক্ষত দেহ। প্রিয় জনের কান্না। বিচ্ছিন্নতার শেষ বুঝি এই ভাবেই হয়। মোমোতেই তাহা থামিবে, আরও একটি মারণ খেলা ভাসিয়া উঠিবে না, সেই ভরসা কোথায়?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন