আর, ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা?

পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজারহাট অঞ্চলের একটি বুথে ‘সেকেন্ড পোলিং অফিসার’-এর ডিউটি পড়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গার বাসিন্দা প্রাইমারি-স্কুলশিক্ষক মনিরুলের।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share:

রাজকুমার রায়কে প্রায় সকলেরই মনে আছে, কিন্তু মনিরুল ইসলামের কথা মনে রেখেছেন ক’জন? গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় উত্তর দিনাজপুরে ইটাহারের একটি বুথ থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায়। পরে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় রেললাইনের ওপর। যে হেতু রাজকুমারবাবুর মৃত্যু-রহস্যের কিনারা হয়নি আজও, তাই তাঁকে নির্বাচনী-হিংসার বলি বলা যেতে পারে কি না সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। মনিরুল সাহেব কিন্তু বেঁচে আছেন— ভোটকর্মী হিসেবে নির্বাচনী-সন্ত্রাসের শিকার এবং তৎপরবর্তী রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার জলজ্যান্ত নিদর্শন হিসেবে।

Advertisement

পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজারহাট অঞ্চলের একটি বুথে ‘সেকেন্ড পোলিং অফিসার’-এর ডিউটি পড়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গার বাসিন্দা প্রাইমারি-স্কুলশিক্ষক মনিরুলের। বুুথ দখল করতে আসা দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মারাত্মক চোট লাগে। দু’মাস চিকিৎসা চলে। এই সময়ে একটি বারও নির্বাচন কমিশন তাঁর খোঁজ নেয়নি। পরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মামলার হুমকি দিলে চাপে পড়ে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে তাঁর চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে দেওয়া হয়। উক্ত মনিরুল ইসলামের হাতে ভোটকর্মীর নিয়োগপত্র ধরানো হয়েছে এ বারের লোকসভা নির্বাচনের জন্যও।

নির্বাচন নামক মহাযুদ্ধে দু’টি পক্ষই সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে, যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলি এবং তাদের ভাগ্য-নির্ধারক জনতা। তৃতীয় পক্ষ যাঁরা, সেই ভোটকর্মীদের কথা সে ভাবে হয় না। কারণ প্রথমত, তাঁরা সংখ্যায় নিতান্তই কম, উপরন্তু একেবারে নিপাট শান্তিপ্রিয় মধ্যবিত্ত। এ বারে, এই লোকসভা নির্বাচনের মুখে সেই নির্বিবাদী শান্ত মানুষগুলোই কিন্তু বেঁকে বসছেন। জেলায় জেলায় বিক্ষোভ করছেন তাঁরা। রাজকুমার রায় যে জেলার বাসিন্দা ছিলেন, সেই উত্তর দিনাজপুরে ভোটকর্মীরা প্রতিটি বুথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার আশ্বাস না পেলে ভোট-ডিউটি বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্য জেলাতেও তথৈবচ। ‘পোলিং পারসোনেল’-এর ডিউটি থেকে অব্যাহতি চেয়ে জমা পড়া আবেদনপত্রের সংখ্যা নাকি হুগলি জেলায় বারোশো এবং উত্তর চব্বিশ পরগনাতে দু’হাজার ছাড়িয়েছে। বেশির ভাগই ‘মেডিক্যাল গ্রাউন্ড’, নিজের বা বাবা-মা বা সন্তানের অসুস্থতার অজুহাত। ভোটের মুখে এত জন সরকারি কর্মচারীর অসুস্থ হয়ে পড়াটা ‘স্বাভাবিক’ নয়। ফলে আবেদনগুলির সত্যতা যাচাই করতে একাধিক মেডিক্যাল বোর্ড বসাতে হচ্ছে।

Advertisement

পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার কারণ হল, ‘নিরাপত্তার অভাববোধ’। ভোটকর্মীরা কোনও দিনই খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কাজ করতে পারেন না। ওই দু’দিন তাঁদের ওপর কাজের চাপ থাকে অসহনীয়, শুতে হয় স্কুলবাড়ির মেঝেতে বিছানা পেতে, নাওয়া-খাওয়ার ঠিক-ঠিকানা থাকে না। পানীয়জল এবং খোরাকির ব্যবস্থাও তাঁদের নিজেদেরই করতে হয়, সে বাবদ কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে দায় সারে নির্বাচন কমিশন। একটু ভিতরের দিকের কোনও গ্রাম হলে বিদ্যুতের সংস্থান মিলবে কি না সে ব্যাপারে প্রায়শই কোনও নিশ্চয়তা থাকে না, টয়লেট এবং জলের সমস্যা তো অপরিহার্য। এবং এই সবের বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক তাঁরা পান, নির্বাচন-বাবদ বিপুল সরকারি ব্যয়-বাহুল্যের অনুপাতে তা নিতান্ত তুচ্ছ। তা-ও প্রতিটি বুথে নির্বাচন নামক মহাযজ্ঞে পৌরোহিত্যের কাজ এত দিন তাঁরা দায়িত্ব সহকারে করে এসেছেন। কিন্তু প্রাণের দায় বড় দায়। বিশেষত গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে তাঁদের।

অথচ, গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে নিরপেক্ষ অথচ সবচেয়ে অসহায় ভূমিকায় থাকেন কিন্তু এই ভোটকর্মীরাই। মাঝে মাঝেই তাঁদের বিরুদ্ধে শাসক বা বিরোধী দলের হয়ে ‘কাজ করার’ অভিযোগ ওঠে। অথচ কোনও বুথে যে চার-পাঁচ জন ভোটকর্মী থাকেন, তাঁদের দলটা তৈরি হয় কম্পিউটারে, ‘‍র‌্যানডম সিলেকশন’-এর মাধ্যমে। ফলে তাঁদের মধ্যে আগাম পরিচয়ের কোনও সুযোগ থাকে না। কোথায় কোন বুথে তাঁরা ভোট করাতে যাচ্ছেন, সেটাও তাঁরা জানতে পারেন ভোটের আগের দিন। এখন, চার জন প্রায় অচেনা লোকের পক্ষে একজোট হয়ে অচেনা পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ওই জাতীয় অপকর্ম করা কি আদৌ সম্ভব?

দ্বিতীয়ত, ভোটকর্মীরা জানেন যে, তাঁদের নিয়ে কোনও অভিযোগ জমা পড়লে নির্বাচন কমিশন ছেড়ে কথা বলবে না। ইনক্রিমেন্ট বাজেয়াপ্ত হওয়া থেকে সাসপেনশন পর্যন্ত অনেক কিছু হতে পারে।

অবিশ্যি বোমা-বন্দুক হাতে মস্তানের দল বুথ দখল করতে এলে যখন তাঁরা বুথের বাইরে রাইফেলধারীকে যোগনিদ্রাভিভূত অবস্থায় দেখেন, তখন নিরুপায় হয়ে তাঁরাও অন্ধ হওয়ার ভান করেন। তাঁরা কেউই বাঁটুল দ্য গ্রেট বা দক্ষিণী সিনেমার নায়ক নন, ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ। আর ট্রেনিংয়ে কী ভাবে ভোটপর্ব পরিচালনা করতে হবে তার খুঁটিনাটি পাখিপড়ার মতো করে শেখানো হলেও বুথদখল, বোমাবাজির ক্ষেত্রে ভোটকর্মীদের কী করণীয় তা নিয়ে কমিশন উচ্চবাচ্য করে না। তাই তেমন প্রয়োজনে ফোন বা এসএমএস করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকে না। যত ক্ষণে নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে গিয়ে পৌঁছয়, তত ক্ষণে যা হওয়ার তা হয়েই যায়।

আর একটা জরুরি কথা। ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে আহত হলে ভোটকর্মীদের ব্যক্তিগত চিকিৎসা-বিমার সুবিধা পেতেও যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যে স্বয়ং নির্বাচনী সন্ত্রাসে জড়িত ছিলেন না, সেই মর্মে পুলিশের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়, যেটা সহজে মেলে না।

শুধু ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নয়, গণতন্ত্রকে নিশ্ছিদ্র করার স্বার্থেই এই পদক্ষেপ জরুরি। ভোটকর্মী বা ভোট দিতে আসা নাগরিক— নির্বাচনী হিংসার শিকার হয়ে যদি কাউকে প্রাণ দিতে হয়, গণতন্ত্রের পক্ষে তার থেকে বড় লজ্জার ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন