এই যে আমি

খ্যাতি চাহিবার মধ্যে কোনও অন্যায় নাই, খ্যাতি পাইবার যোগ্যতা নাই তাহা না মানিয়া লইবার মধ্যে, এবং এলোপাথাড়ি অকর্ম করিয়া প্রকাশ্যে বক্ষ স্ফীত করিয়া দাঁড়াইবার মধ্যে অপরিণতমনস্কতা আছে, হুজুগের প্লাবনে ভাসিয়া বিচারক্ষমতা বিসর্জন দিবার দ্যোতনা আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৩৮
Share:

শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল ১৯৬৮ সালে বলিয়াছিলেন, ভবিষ্যতে একটি সময় আসিবে যখন সকলেই ১৫ মিনিটের জন্য বিশ্ববিখ্যাত হইবে। তিনি আন্দাজ করিতে পারেন নাই যে ফেসবুক বা ইউটিউব গোত্রের বস্তু আবিষ্কৃত হইবে, যাহা মানুষকে ১৫ সেকেন্ডের বিশ্বখ্যাতি দিবার পক্ষে আদর্শ। মানুষ যে সেই প্রকারের খ্যাতির জন্য কী পরিমাণ কাঙালপনা করিতে পারে, তাহা জানিলে অ্যান্ডির অত্যাধুনিক শিল্পধারণা-রঞ্জিত চক্ষুও বিস্ফারিত হইত। সেলফি তুলিতে গিয়া কেহ ব্রিজ হইতে পড়িয়া প্রাণ হারাইতেছে, কেহ নিজ অন্তরঙ্গতম মুহূর্তের ছবি চট করিয়া পোস্ট করিতেছে, কেহ আত্মহত্যা করিবার সময় তাহা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করিতেছে, যেন তেন প্রকারেণ নিজেকে বহু মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে আনিবার জন্য যেন সমগ্র সমাজ হাঁকপাঁক করিতেছে। পূর্বে খ্যাতি পাইবার জন্য কিছু মানুষ ঝাঁপাইতেন, বাকিরা ইচ্ছা থাকিলেও সাধ্য নাই বলিয়া ওই পথ মাড়াইতেন না। কিন্তু এখন তো বারান্দায় চড়াইপাখি বসিলেও তাহার ছবি তুলিয়া আপন সৃষ্টির জাঁক করা যাইতে পারে, নিজ অতি গড় ও ঘটনাবিহীন দৈনন্দিন যাপনও প্রকাশ্যে সাড়ম্বরে উদ্‌যাপন করা যায়, কিছু না জুটিলে প্রতিষ্ঠিত কাহাকেও বেলাগাম গালাগালি দিয়া কিঞ্চিৎ নাম কিনিবার চল হইয়াছে। তাই সকল মুড়িই মিছরি হইবার খেলায় নামিয়া পড়িয়াছে, খ্যাতি এখন প্রায় খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়ের ন্যায়ই জৈবিক চাহিদা। মুশকিল হইল, যে লোক কাব্য করিয়া খ্যাতি চাহেন, বা যিনি ক্রিকেট খেলিয়া খ্যাতি চাহেন, তাঁহাদের কার্যপ্রণালী মোটামুটি নির্দিষ্ট। কিন্তু যিনি কিছুই পারেন না, কোনও দিকেই প্রবল ঝোঁকও নাই, কেবল তীব্র আকাঙ্ক্ষাটুকু রহিয়াছে, তিনি মরিয়া হইয়া হাতড়াইতে থাকেন। কখনও মনে হয় সন্তানের জন্মদিনে উদ্ভট আমন্ত্রণ-প্রণালী ঠাওরাইলে সকলে আমায় লইয়া হইচই করিবে, কখনও মনে হয় মাথায় অন্তর্বাস পরিয়া নিউ মার্কেট ঘুরিয়া আসিলে কেমন হয়।

Advertisement

কিছু দিন পূর্বে কয়েক জন যুবক ভাম কাটিয়া খাইল ও তাহার ছবি সাড়ম্বরে ফেসবুকে দিল। ভাম সংরক্ষিত প্রজাতি, কিন্তু তাহা কাহারও অজানা থাকিতেই পারে। প্রশ্ন হইল, সংরক্ষিত হউক আর না হউক, এক প্রাণীকে ধরিয়া মারিয়া কাটিবার মধ্যে কোন বৃহৎ বাহাদুরি রহিয়াছে? তবে কি সাধারণ মানুষ অন্যান্য জন্তু খাইলেও, কেহই প্রায় ভাম খায় না, কেবল এই কারণে প্রাণীটিকে হত্যা করিয়া তাহা ফলাও প্রচারের ইচ্ছা জাগিল? কেবল অন্য রকম একটি সংবাদের জন্ম দিয়া কলরোল তুলিবার জন্য তবে নিরীহ জীবকে হত্যাও চলিবে? আর এক ব্যক্তি দাঁতাল হস্তীকে স্যালুট করিবার তাড়নায় গাড়ি হইতে নামিয়া হাতির নিকটে চলিলেন। বারংবার নিষেধ শুনিলেন না। তিনি এই ছবি ফেসবুকে দিবার কথা ভাবিয়াছিলেন কি না তাহা বড় কথা নহে, কিন্তু তিনিও ক্ষণিক চমক সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন। হয়তো অতগুলি লোকের সম্মুখে সহসা নায়ক, বা অন্তত ভাঁড় হইবার ইচ্ছা জাগিয়াছিল। হস্তী তাঁহাকে পিষিয়া দিবে, এমন আশঙ্কা নিশ্চয়ই করেন নাই, ভাবিয়াছিলেন বিপজ্জনক জন্তুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া অবান্তর অদ্ভুত কার্য করিলে অসমসাহসিকতার জন্য তাঁহার কয়েক সেকেন্ডের খ্যাতি হইবে, তাঁহাকে লইয়া আলোচনা হইবে, এই ছবি মোবাইলে তুলিয়া অনেকে ছড়াইয়াও দিবে।

‘আমাকে দেখুন’ প্রবৃত্তি মানুষের নূতন নহে। কেহ তর্ক করিতে পারেন, প্রতিটি শিল্পীরই এই আকিঞ্চন রহিয়াছে, নহিলে তাঁহারা বই ছাপাইতেন না, জলসা করিতেন না। সাধারণ মানুষও নিশ্চয় মনোযোগ যাচ্ঞা করেন, নহিলে পারিবারিক অনুষ্ঠানে চিৎকার করিয়া রসিকতা বলিতেন না। প্রবণতাটি লইয়া প্রশ্নটি নহে, ভাবিবার বিষয় হইল প্রক্রিয়াটি। নিজের বা অন্যের ক্ষতি করিয়াও, মৃত্যু বা হত্যার মধ্য দিয়া গিয়াও কয়েক মুহূর্তের মনোযোগ চাহিব, ইহা বিকৃত মনোবৃত্তি। খ্যাতি চাহিবার মধ্যে কোনও অন্যায় নাই, খ্যাতি পাইবার যোগ্যতা নাই তাহা না মানিয়া লইবার মধ্যে, এবং এলোপাথাড়ি অকর্ম করিয়া প্রকাশ্যে বক্ষ স্ফীত করিয়া দাঁড়াইবার মধ্যে অপরিণতমনস্কতা আছে, হুজুগের প্লাবনে ভাসিয়া বিচারক্ষমতা বিসর্জন দিবার দ্যোতনা আছে। লাগাতার অন্তঃসারশূন্য খ্যাতিপ্রয়াসে মানুষ নিজেকে ও সভ্যতাকে, সাধারণ সহজ বুদ্ধিকে অপমান করিতেছে। সেই অপমানে তাহাদের সমান না হইয়া, কেহ কেহ উচ্চতাভিলাষী হইলে, সকলেরই মঙ্গল, কারণ প্রতি ১৫ সেকেন্ডে নূতন করতালি দিতে হইলেও তো হস্তে পীড়া ঘটে!

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

চ্যানেল ভি বন্ধ হয়ে গেল। সত্যি, লোকে মোবাইলেই সব গান দেখে-শুনে নিলে আর ওই চ্যানেলের কী দরকার। যখন এসেছিল, ‘ভি’ ছিল সপ্রতিভতা এবং বহু প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি দিব্যি অশ্রদ্ধার আস্তানা। গোঁড়া দেশে তা ছিল মিনি-বিপ্লব। অবশ্য সে প্রবণতা ছেড়ে এখন নতজানু হওয়ার দিন এসেছে, ‘জানে ভি দো ইয়ারোঁ’র সংলাপ-রচয়িতা বলেছেন, এ সময়ে অমন ছবি করলে তাঁর ও পরিচালকের ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হত। তা হলে মিনমিনিয়ে ‘ভি, জানে দো ইয়ারোঁ’ বলাই ভাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন