সম্পাদকীয় ১

দায় এবং অধিকার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বলিয়াছেন, মুসলিম সমাজের মধ্য হইতে ইসলামিক স্টেট-এর হামলা ও তাহার ‘মতাদর্শ’-এর বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ গর্জিত হওয়া জরুরি। উল্লেখযোগ্য, ভারতে সেই প্রতিবাদ গর্জিত হইল। দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমদ বুখারি-সহ সহস্রাধিক ভারতীয় ইমাম ও নেতৃস্থানীয় মুসলিম একত্রে একটি প্রতিবাদপত্র তৈরি করিয়াছেন, আইএস সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জেও প্রেরণ করিয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪৯
Share:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বলিয়াছেন, মুসলিম সমাজের মধ্য হইতে ইসলামিক স্টেট-এর হামলা ও তাহার ‘মতাদর্শ’-এর বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ গর্জিত হওয়া জরুরি। উল্লেখযোগ্য, ভারতে সেই প্রতিবাদ গর্জিত হইল। দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমদ বুখারি-সহ সহস্রাধিক ভারতীয় ইমাম ও নেতৃস্থানীয় মুসলিম একত্রে একটি প্রতিবাদপত্র তৈরি করিয়াছেন, আইএস সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জেও প্রেরণ করিয়াছেন। ভারতীয় মুসলিম প্রতিনিধিদের কণ্ঠ গোটা দুনিয়ায় দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল। এত বড় মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের ইসলামি নেতৃত্বের জোরালো অবস্থান অন্যান্য মুসলিম দেশেও প্রভাব ফেলিবে, আশা করা যায়। তাঁহারা দেখাইয়া দিলেন, রাষ্ট্রশক্তির তোয়াক্কা না করিয়া বৃহত্তর সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা কমিউনিটির মধ্য হইতেও প্রতিবাদ উৎসারিত করা সম্ভব। মুসলিম বলিয়া অসহায় বা ভীত বোধ না করিয়া, নিজের সমাজ-পরিচয় ও ধর্মপরিচয়ে আস্থা রাখিয়া, আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হইয়া এই কুৎসিত কাণ্ডের নিন্দা করা সম্ভব। ভারতের সংখ্যালঘু সমাজের নেতারা যদি স্ববলে স্থিত হইয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রত্যয়ী ‘ফতোয়া’ দিতে পারেন, তবে অন্যান্য মুসলিম দেশের পক্ষে তাহা সহজতর হওয়া উচিত। তাঁহাদের সম্মিলিত কণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া উঠুক। কদর্য মানবতাবিরোধীরা সেই ধ্বনিতে আতঙ্কিত, অন্তত চিন্তিত বোধ করিবে। তাহাই কাম্য।

Advertisement

এই ধারণার প্রেক্ষিতে কী ধরনের প্রত্যুত্তর শানাইয়া উঠিতে পারে, কল্পনা করিতে কষ্ট হয় না। কেন মুসলিম বলিয়াই আইএস জাতীয় সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদ করিতে হইবে, কেন এই ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য মুসলিমত্বের সূত্রে সকল মুসলিমের একটি ‘আলাদা দায়’ বর্তাইবে? বিভিন্ন দেশের ধর্মভীরু কিংবা ধর্ম-উদাসীন মুসলিম জনসাধারণকে এই সংশয় কখনও ব্যথিত, কখনও উদ্বিগ্ন, কখনও ক্রুদ্ধ করিয়া তোলে। মুক্তমনা অ-মুসলিম মানুষেরও এই উদ্বেগ বা ক্রোধের শামিল হইতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। এ বিষয়ে একটিই কথা বলিবার। এ ধরনের সাধারণীকরণের প্রবণতা একটি সামাজিক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে অজস্র বার বলা হইয়াছে, কেন এই অপরাধ অক্ষমণীয়, বিপজ্জনক। কিন্তু সাধারণীকরণের বাহিরেও একটি কথা থাকিয়া যায়। তাহা যে কোনও সমাজের সদস্যদের নিজস্ব নৈতিক দায়। ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদীরা যখন বলে, বিধর্মীদের হত্যা করা তাহাদের ধর্মাচার, তখন তাহা যে ইসলাম বা যে কোনও ধর্মবোধেরই পরিপন্থী, এই মৌলিক নৈতিকতার কথাটি অ-মুসলিমরা বলিলে এক রকম শোনায়, আর মুসলিমরা বলিলে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। সেই অর্থে ইহা একটি ‘আলাদা দায়’ই বটে। যে কোনও সমাজ বা সম্প্রদায়ের নামেই ভয়ানক অনৈতিকতা সাধিত হইলে, সেই সমাজ বা সম্প্রদায়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমালোচনার দায়িত্ব থাকিবেই।

এবং, দায়িত্বের বাহিরেও, ইহা অধিকারের প্রশ্ন। ইসলামিক স্টেট বলিয়া যে কাণ্ডটি ঘটিতেছে, তাহার মধ্যে যে ইসলাম নাই, আছে কেবল অমানবিকতার দিশাহীন উৎসব: তাহা বলিবার অধিকারটিও মুসলিমদেরই সর্বাধিক নয় কি? অ-মুসলিমরাও তাহা নিশ্চয়ই বলিতে পারেন, বলা আবশ্যকও, কিন্তু তাঁহারা ইসলামের জ্ঞান, দর্শন বা আচার না জানিয়া বা অংশত জানিয়াই তাহা বলেন। প্রকৃত ইসলাম কী, সে কথা বলিবার বা বুঝাইবার ক্ষমতা বা অধিকার তাঁহাদের কয় জনের আছে? সুতরাং প্রকৃত ইসলামকে অপ্রকৃতিস্থদের হাত হইতে বাঁচাইবার দায়টি মুসলিম সমাজের একান্ত নিজস্ব প্রয়োজন। বেনোজল ঢুকিয়া প্লাবন বহাইতেছে। সংস্কারের কাজ ভিতরেই শুরু হইতে হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন