krishna bose

শ্রীকৃষ্ণা বসু (১৯৩০-২০২০)

তিনি পেশাদার রাজনীতিক ছিলেন না। রাজনীতি বরং তাঁর বৈদগ্ধ এবং মান্যতাকে সামনে রেখে নিজেদের ‘পাওনা’ আদায় করেছে। ফলে তাঁর কোনও বক্তব্যের প্রসারিত প্রতিক্রিয়া হতে পারে বুঝেও নিজের উচ্চতাকে তিনি খাটো হতে দেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

যুগাবসান কথাটি কোনও কোনও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যাঁরা কর্মময় দীর্ঘজীবন পিছনে রেখে যান, যাঁদের চলার পথ ইতিহাস তৈরি করে বা যাঁরা ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী থাকেন তাঁরা লৌকিক অভিযাত্রা শেষ করলে যুগের অন্ত হয়। কৃষ্ণা বসু সম্পর্কে এটি সর্বাংশে প্রযোজ্য।

Advertisement

কিন্তু এর চেয়েও অধিক হল শূন্যতাবোধ। যার অভিঘাত আরও ব্যাপক। কৃষ্ণা বসুর প্রয়াণ সামাজিক পরিসরে এমনই এক শূন্যতা তৈরি করল। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি, মতামত, লেখা, মূল্যায়ন নিয়ত আমাদের বোধকে সমৃদ্ধ করেছে। নব্বইয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও নব্য চিন্তার উন্মেষ তাঁকে আমৃত্যু সজীব রেখেছিল। তিনি তা ছড়িয়ে দিতেন। আজ তার শেষ হল।

শিক্ষা, আভিজাত্য, বংশগৌরব সব ছিল তাঁর। সঙ্গে ছিল এক অমায়িক, মাতৃময়ী, নিরহংকার ব্যক্তিত্ব। যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন, স্নেহের টানে বাঁধা পড়তে হয়েছে তাঁদের। কৃষ্ণা বসু তাঁদের কারও দিদি, কারও মাসিমা, কারও ম্যাডাম হয়ে আপন করে নিতে পেরেছেন সকলকে।

Advertisement

শরৎ বসু-সুভাষ বসুর পরিবারের বধূ, শিশির বসুর পত্নী কৃষ্ণা দেবীর এই পরিচয় অবশ্যই তাঁকে আজীবন বিশেষ সম্ভ্রমের আসনে বসিয়েছে। তবে তাঁর পিতৃকূলও গরিমায় উজ্জ্বল। কৃষ্ণাদেবীর বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরীর সংবিধান বিষয়ে প্রজ্ঞা ছিল। তারই জোরে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার সচিব হয়েছিলেন তিনি। কৃষ্ণা বসুর কাকা নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তিনি আবার শিশির বসুর বাবা শরৎচন্দ্রের একান্ত সচিব হয়ে কাজ করেছেন কিছুদিন।

১৯৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় কৃষ্ণাদেবীর জন্ম। মা ছায়া দেবীচৌধুরাণি। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকেই মেধাচর্চা শুরু। ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে উচ্চশিক্ষা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং এম এ পাশ করেন কৃষ্ণা বসু। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও বিশেষ দক্ষতা ছিল তাঁর। লখ্‌নউয়ে ভাতখন্ডে মিউজিক ইন্সটিটিউট থেকে ‘সঙ্গীত বিশারদ’ ডিগ্রি পেয়েছিলেন তিনি।

কৃষ্ণাদেবীর উন্মেষের নেপথ্যে তাঁর শ্বশুরকুলের ভূমিকা অবশ্যই অনেকখানি। তবে ১৯৫৫ সালে শরৎচন্দ্র বসুর পুত্র এবং সুভাষচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র চিকিৎসক শিশিরকুমার বসুর সঙ্গে যখন তাঁর বিয়ে হয়, তার আগেই কৃষ্ণাদেবী কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে দিয়েছেন। কলকাতার সিটি কলেজের প্রাতর্বিভাগে টানা চল্লিশ বছর ইংরেজি পড়িয়েছেন তিনি। অবসরের আগে আট বছর ছিলেন অধ্যক্ষ।

সুভাষচন্দ্রের পরিবারে বধূ হয়ে আসা অবশ্যই কৃষ্ণাদেবীর জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যদিও পিতৃকুল থেকেই তাঁর চেতনায় দৃঢ় জাতীয়তাবোধের বীজ বপন করা শুরু হয়েছিল। বাবা চারুচন্দ্র তাঁকে শোনাতেন স্বাধীনতা যোদ্ধাদের কথা। শেখাতেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির মন্ত্র। তবে বিবাহোত্তর জীবনে তা পত্রে-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয়, কৃষ্ণাদেবীর জীবনের প্রিয়তম পুরুষ হয়ে এলেন যিনি, সেই শিশিরকুমার, ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের অন্তরঙ্গ সহচর ও সাক্ষী। সবাই জানেন, ১৯৪১-এ ব্রিটিশের পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে সুভাষচন্দ্র যেদিন এলগিন রোডের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান, সেদিন তাঁকে গাড়ি চালিয়ে গোমো পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন ভাইপো শিশির।

এমন এক ব্যক্তির সহধর্মিণী হওয়ার গর্ব চিরদিন সযত্নে লালন করেছেন কৃষ্ণা বসু। শুধু তা-ই নয়, নিজেকে তিনি সর্বদা নিয়োজিত রেখেছিলেন নেতাজি-চর্চায়। যার অনুষঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান ভারতের বিবিধ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদগ্ধ পর্যবেক্ষণ ছিল তাঁর। নিজের উপলব্ধির কথা বলতেন অকপটভাবে।

যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এসেছেন, তখনও কোনও বিষয়ে, বিশেষ করে যদি তা সামাজিকভাবে সংবেদনশীল হয়, নিজের মতামত জানাতে দ্বিধা করতেন না কৃষ্ণা বসু। কে কী বলবে বা তাঁর দলের পক্ষে কোন কথা কতদূর গ্রহণযোগ্য হবে, এসব না ভেবেই নিজের বক্তব্য জানানোর মানসিক জোর তাঁর ছিল। এর এক বড় কারণ, তিনি পেশাদার রাজনীতিক ছিলেন না। রাজনীতি বরং তাঁর বৈদগ্ধ এবং মান্যতাকে সামনে রেখে নিজেদের ‘পাওনা’ আদায় করেছে। ফলে তাঁর কোনও বক্তব্যের প্রসারিত প্রতিক্রিয়া হতে পারে বুঝেও নিজের উচ্চতাকে তিনি খাটো হতে দেননি।

রাজনীতিতে কৃষ্ণাদেবীর পদার্পণ ঘটেছে অনেক পরে। তখন তিনি ৬৫ অতিক্রান্ত। শিশিরকুমারও ততদিনে সরাসরি রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন শিশিরবাবু। আর কৃষ্ণা বসু প্রথম কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে যাদবপুর থেকে জিতে লোকসভায় যান ১৯৯৬-তে। তারপরে আরও দু’বার ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯-তে ওই একই কেন্দ্র থেকে সাংসদ হন তিনি। সেই দু’বারই তৃণমূলের প্রতীকে।

রাজনীতির এই গতিপথ সহজেই বুঝিয়ে দেয়, তাঁর সঙ্গে আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। বস্তুত কৃষ্ণাদেবী প্রথম লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোর সময় থেকেই তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। মমতা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়ার পরে ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে প্রথম যাঁরা তাঁর সঙ্গে এসে ভোট লড়েন, কৃষ্ণাদেবী তাঁদের একজন।

এই ঘনিষ্ঠতা শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। তাই ব্যক্তিগত সম্পর্কের দাবিতে ২০১৪ সালে কৃষ্ণাদেবীর বড় ছেলে, হার্ভার্ডে ইতিহাসের অধ্যাপক সুগত বসুকে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকেই তৃণমূল প্রার্থী করে ভোটে জিতিয়ে লোকসভায় নিয়ে গিয়েছিলেন মমতা।

সাংসদ হিসাবেও কৃষ্ণাদেবীর ভূমিকা খুব বর্ণময়। লোকসভায় তাঁর বক্তৃতার ওজন এবং গভীরতা সকলের দৃষ্টি আকর্ণ করত। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে লোকসভায় বিদেশ মন্ত্রক বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটিতে চেয়ারপার্সন পর্যন্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দল তাঁকে কখনও মন্ত্রী করতে চায় নি। এর পিছনে কোনও গূঢ় কারণ ছিল কিনা, তা বলা কঠিন। তবে কৃষ্ণা বসুর প্রেক্ষিত থেকে দেখলে বিষয়টি অনভিপ্রেত। প্রসঙ্গত মনে আসে তাঁর লেখা একটি বইয়ের কথা— ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’। বড় অর্থপূর্ণ এই শিরোনাম!

সাংসদ-জীবন শেষ হওয়ার পরে তাঁর কাজের প্রায় সবটুকু জুড়ে ছিল নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো। ২০০০ সালে শিশিরকুমারের প্রয়াণের পর থেকে কৃষ্ণাদেবী ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সন। পাশাপাশি বজায় ছিল লেখালিখি, বক্তৃতা। অনেক বই লিখেছেন তিনি। ‘চরণরেখা তব’, ‘প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র’, ‘এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’ তার কয়েকটি।

দুই ছেলে, এক মেয়ের সার্থক জননী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই। বড় ছেলে সুগত হার্ভার্ডে, ছোট সুমন্ত্র পড়ান লন্ডন স্কুল অফ ইক্‌নমিক্সে। মেয়ে শর্মিলা আমেরিকায় সাংবাদিকতা করেন। তবে এখন অক্সফোর্ডে একটি গবেষণার কাজ করছেন। ছেলেরা সর্বদা আগলে রাখতেন মাকে। বারবার ছুটে আসতেন কলকাতায়।

বয়োভারে চলাফেরার অসুবিধা হচ্ছিল কিছুদিন। মাসদুয়েক আগে চোখে অস্ত্রোপচার হয়। তবু পড়া, লেখা কিছুই বন্ধ হয় নি। পরিকল্পনা চলছিল শিশিরকুমারের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের জন্য বড় অনুষ্ঠান করার।

সব দায়িত্ব উত্তরসূরিদের কাঁধে চাপিয়ে কৃষ্ণা বসু ভারমুক্ত হলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন