বঙ্গশকট

সত্যই তাহা হইলে, এক পৃথিবীর ভুলচুক হইয়া যাইবে। অটো লইব, আর বাংলার অটোর সংস্কৃতি লইব না, প্রবল অন্যায়। অটো নিশ্চয় বহু স্থানেই চলে, কিন্তু বঙ্গীয় অটোর ন্যায় তাহা প্রাণবান ও আখ্যানময় হইতেই পারে না, এই যানের প্রতি এই রাজ্যে যে পরিমাণ নির্ভরশীলতা ও বিরক্তি বিষাদ বিবমিষা সম্মিলিত হইয়াছে, তাহা অন্যত্র সম্ভব নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০০:৩২
Share:

গত ২২ মার্চ ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরে চালু হইল অটো রিকশা। অবশ্য যানটিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে প্রচলিত টুক-টুক বলিয়াও ডাকা হইতেছে। গোলাপ যে নামেই ডাকো, গোলাপই থাকিবে, তবে অটোকে টুক-টুক বলিলে বঙ্গবাসীর ক্ষোভ হইতে পারে, বরং শনশন বা শাঁইশাঁই বলিলে সুবিচার হইত। একটি সংস্থা অটোগুলির আয়োজন করিয়াছে, অন্যান্য সংস্থার ট্যাক্সি-পরিষেবাকে বেগ দিবার জন্য। হয়তো গোঁ-গোঁ করিয়া দ্রুত ধাবমান ট্যাক্সির তুলনায়, মুক্তদ্বার যানগুলিতে টুকটুক করিয়া যাইতে বিলাতি মানুষদের ভালই লাগিবে। উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের অটোগুলি প্রথম দিন বিনামূল্যে লিভারপুল সিটি সেন্টারের আশেপাশে যাত্রীদের লইয়া যাইল। এপ্রিলের পূর্বে যাঁহারা অ্যাপ ডাউনলোড করিয়া অটোয় চড়িবেন, প্রথম যাত্রায় ৫০% ছাড় পাইবেন। ইহার পূর্বে লন্ডনে, ২০১৫ সালে এক প্রদর্শনী ও নিলামের জন্য একটি অটোকে সাজাইয়াছিলেন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজ়াইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়। অটোর সমগ্র অঙ্গে বিবিধ পুষ্পল নকশা, আসনের কুশনে বাংলার বাঘ, চাকার কেন্দ্রস্থলেও ব্যাঘ্রের মুখ উঁকি মারিতেছিল। কিন্তু তাহা নিতান্তই শিল্পবস্তু হিসাবে প্রদর্শিত ও সমাদৃত হইয়াছিল। তাহার সত্তা ছিল ভারতীয়। লিভারপুলের অটোগুলির স্বভাব হয়তো বিলাতি হইবে।

Advertisement

সত্যই তাহা হইলে, এক পৃথিবীর ভুলচুক হইয়া যাইবে। অটো লইব, আর বাংলার অটোর সংস্কৃতি লইব না, প্রবল অন্যায়। অটো নিশ্চয় বহু স্থানেই চলে, কিন্তু বঙ্গীয় অটোর ন্যায় তাহা প্রাণবান ও আখ্যানময় হইতেই পারে না, এই যানের প্রতি এই রাজ্যে যে পরিমাণ নির্ভরশীলতা ও বিরক্তি বিষাদ বিবমিষা সম্মিলিত হইয়াছে, তাহা অন্যত্র সম্ভব নহে। বাংলায় বহু অটোচালক মনে করেন, অভদ্রতা তাঁহার জন্মগত অধিকার, কেহ কলহের উত্তেজনায় যাত্রীকে সপাট চপেটাঘাতও করিয়াছেন। কোনও অটোচালককে ট্র্যাফিক পুলিশ যদি শাস্তি দেন, প্রায়ই সেই রুটে চালকেরা রাস্তা অবরোধ করেন বা অটোচালনা বন্ধ করিয়া দেন। সব মিলাইয়া অটো বাংলার অরাজকতা ও অসৌজন্যের উজ্জ্বল প্রতীক। ব্যতিক্রম অবশ্যই অাছেন, আর সকল যাত্রীই যে ধৌত তুলসীপত্র তাহাও নহে, তবে চালকদের ঔদ্ধত্য প্রায় নিয়ম হইয়াই দাঁড়াইয়াছে। লিভারপুলে যাঁহারা অটো চালাইবেন, তাঁহারা কি ভাড়া খুচরায় প্রদানের জন্য যাত্রীদের শাসাইতে পারিবেন? কর্ণপটহ বিদীর্ণ করিয়া গান চালাইতে পারিবেন? বাসস্টপ আড়াল করিয়া সারে সারে অটো দাঁড় করাইতে পারিবেন? উঠিতে সামান্য বিলম্ব করিলে অশক্ত বৃদ্ধাকে খেঁকাইয়া উঠিতে পারিবেন? যানজট দেখিলে ট্রামলাইনে উঠিয়া সবেগে গাড়ি চালাইতে পারিবেন? ক্রমাগত সিগনাল অমান্য করিয়া দক্ষিণে-বামে চরকিপাক লাগাইতে পারিবেন ও সেই কার্যে বাধা পাইলে নিয়মানুবর্তী গাড়ির চালককে বাছাই গালি শুনাইতে পারিবেন? হুট করিয়া বস্তু আমদানি করিলেই হয় না, তাহার আত্মা ও আবেদন সম্পর্কে সম্যক জানিলে, তবে মর্যাদা প্রদান করা হয়।

কর্মশালার আয়োজন নিশ্চয় করা যাইবে, কিন্তু পাশ্চাত্য মূল্যবোধে এইগুলি গ্রহণ করা কঠিন। উহাদের অদ্ভুত ধারণা, সামাজিক জীবনে নাকি সৌজন্য রক্ষা করিয়া চলিতে হয়। পাশ্চাত্যে যখন দুর্গাপূজা হয়, প্রকাণ্ড শব্দে ঢাক বাদন, মাইক বাজাইয়া সহস্র প্লীহা চমকাইয়া দেওয়া, এই কার্যগুলি করিতে দেওয়া হয় না। কিন্তু অন্যকে বিড়ম্বিত করিবার মধ্যে, মানুষকে সাদরে ডাকিয়া অপদস্থ করিবার মধ্যে যে তপ্ত তৃপ্তি, তাহার অভাব পূরণ হইবে কী ভাবে? এইখানেই পাশ্চাত্যের নীরসতা, একাকিত্ব, বিষাদবিস্তারের উৎস। তাহাদের পথেঘাটে কাঁউকাঁউ চিৎকার, আছাড়িপিছাড়ি রোদন, ধপাধপ প্রহার, ঝপাঝপ ভিড় জমাইয়া পথ-আদালত বসাইয়া দেওয়া— কিছুই নাই। ফলে তাহাদের দৈনন্দিন জীবন উষ্ণতাহীন, ঘটনাহীন, নিস্তরঙ্গ। অটো আসিয়াছে, তাহার সহিতই আনিতে হইবে দুর্ব্যবহারের আমোদ, এবং অবশ্যই এলিট শ্রেণির প্রতি সাবঅলটার্নের দ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহার তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ। লিভারপুর ‘বিটলস’-এর ধাত্রীভূমি হইতে পারে, কিন্তু গুবরে পোকার ন্যায় গুঁড়ি মারিয়া যে যান চলিবে, তাহার বন্য অনুষঙ্গ বাংলা হইতেই শিখিতে হইবে। কলকাতা লন্ডন হইবে— স্লোগান শুনিয়া অনেকে হাসিয়াছিল। আজ লিভারপুল কলকাতা হইতেছে। অচিরেই বিলাত লেকটাউনের বিগ বেন দেখিয়া ঘড়ি মিলাইবে। তাহার অফিসের বিলম্ব হউক, অটোচালক আরও দুই যাত্রী না পাইলে নড়িবে না!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement