কলিকাতায় আড়াই হাজারেরও অধিক বাড়ি বাসযোগ্য নহে। পুরসভা সেগুলির গায়ে ‘বিপজ্জনক’ বোর্ড টাঙাইয়াছে। অতঃপর? ইতিমধ্যে ভগ্নস্তূপে চাপা পড়িয়া পাঁচ জন প্রাণ হারাইয়াছেন, তাঁহাদের এক জন উনিশ বৎসরের তরুণী। তাঁহাদের সরানো হয় নাই কেন? বিপন্ন বাড়িগুলিতে দোকান-বাজার, গৃহস্থালি কেন রহিয়া যাইতেছে? কেবল মালিকদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া লাভ নাই। দেখা গিয়াছে, পুরসভার একটি বিভাগ যখন বাড়ির মালিকের হাতে বাড়ি খালি করিয়া দিবার নির্দেশ ধরাইতেছে, অপর বিভাগ তখন সেই ঠিকানাতেই ভাড়াটিয়া দোকান, দফতর, কারখানাগুলির ট্রেড লাইসেন্স ফের নবীকরণ করিতেছে। অর্থাৎ পুরসভার কাজেও যথেষ্ট দুর্বলতা ও স্ববিরোধ রহিয়াছে। আবার মালিকেরাও কেহ বাড়ি সারাইবার অঙ্গীকার করিয়া সময় চাহিয়া লন, কেহ আদালত হইতে বাড়ি ভাঙিবার নির্দেশে স্থগিতাদেশ লইয়া আসেন। কখনও আবার শরিকি বিবাদের ফলে মালিকানাই অনির্দিষ্ট থাকিয়া যায়। অপর দিকে, বাড়ি ভাঙিয়া গৃহস্থ পরিবারকে আশ্রয়হীন করিবার বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা রুখিয়া দাঁড়ান, তাই পুরকর্তারাও এ বিষয়ে জোর করিতে নারাজ। চাপের মুখে এখন পাড়ায় পাড়ায় ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলিকে চিহ্নিত করিয়া মালিকদের কারণ দর্শাইবার নোটিস দেওয়ার কথা ভাবিতেছে।
কিন্তু এহ বাহ্য। সমস্যার শিকড় ভাড়াটিয়া সংক্রান্ত আইনে। মালিক যাহাতে ইচ্ছামত, অন্যায় ভাবে ভাড়াটিয়াকে উৎখাত করিতে না পারেন, তাহার জন্য আইনে সুরক্ষার ব্যবস্থা কষিয়া বাঁধা হইয়াছে। কিন্তু তাহার একটি ফল হইয়াছে এই যে, বাড়ির মালিকেরা না পারেন ভাড়াটিয়া উঠাইতে, না পারেন ন্যায্য ভাড়া আদায় করিতে। বাড়ি সারাইবার ইচ্ছা কিংবা রেস্ত, কোনওটিই মালিকের হাতে নাই। ফলে তাঁহারা সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণে নিরুৎসাহ। বৈদ্যুতিন সংযোগের নিরাপত্তা, অগ্নিসুরক্ষা, নিকাশির সংস্কার হইতে স্থাপত্যের মেরামত, কিছুই হইয়া ওঠে না। তাহার ফলে মাঝেমাঝেই বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়া যায়, প্রাণ যায় নিরীহ শ্রমিক, কর্মীদের। কিন্তু পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয় না। কলিকাতার অতি অভিজাত, বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলেও নামমাত্র ভাড়ায় বহু বৎসর ঘর দখল করিয়া রহিয়াছে নানা বাণিজ্যিক সংস্থা, বহু পরিবার। যত পুরাতন ভাড়াটিয়া, ততই সামান্য ভাড়ার অঙ্ক। বাজারের হিসাব অনুসারে ওই অঞ্চলে যথাযথ ভাড়া হয়তো তাহার পাঁচশত গুণ, কিন্তু তাহা আদায় হইবে কী প্রকারে? মামলা করিলেও সময় ও অর্থ অপচয় হইবে। এমনকী যে ভাড়াটিয়া স্পষ্টতই শর্তভঙ্গ করিয়াছেন, তাঁহার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা লইতে কয়েক বৎসর লাগিতে পারে। তাহার পরেও উৎকোচ দিতে হইবে। ভাড়াটিয়া আইনের মূল চালিকাশক্তি ছিল মানবিকতা। কিন্তু, তাহার সহিত সম্পত্তির অধিকারের ন্যায় মৌলিক একটি প্রশ্নের এহেন বিরোধ থাকিলে নূতন পথে ভাবনা আবশ্যক।
বাড়ির মালিকদের আরও কড়া সতর্কবার্তা, আরও ঘন ঘন নোটিস ধরাইয়াই বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা কমিবে না। প্রয়োজন ভাড়াটিয়া আইনকে বাস্তবসম্মত করিয়া তোলা, এবং ভা়ড়াটিয়া উচ্ছেদ-সংক্রান্ত বিবাদের দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা। শহরের উন্নতি করিতে হইলে আবাসের উন্নয়ন করিতে হইবে। নবনির্মিত বাড়ি অধিক লোকের কর্মস্থল, বাসস্থল হইতে পারে। আইনি জটিলতায় তাহা স্থগিত রাখা অর্থহীন। আবার উদ্বৃত্ত ঘর থাকিলেও তাহা ভাড়া দিতে নারাজ বহু মালিক। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হইবার ফলে ভাড়া বাড়িয়া যায়। আজিকার গতিময় কর্মজীবনে বাসস্থানের অভাব উন্নয়নে একটি বড় বাধা। পুরাতন নিয়ম না বলাইলে পুরাতন বাড়ি দূর হইবে না।