বারো-চোদ্দো বছর আগের কথা। মফস্সলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে আচার্যের প্রতিনিধি ছিলাম। এক বার কলেজে-কলেজে পাইকারি হারে আসনসংখ্যা বাড়াবার প্রস্তাব উঠল। প্রতিবাদ করলাম: শিক্ষক নেই, পরিকাঠামো নেই, ক্লাসে ক’টা বেঞ্চি আছে সন্দেহ। শুনে সকলে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন: ‘আপনি ব্যাপারটা বুঝছেন না, যে করে হোক আমাদের ছাত্রসংখ্যা কমাতে হবে। হেঁয়ালির উত্তরটা জানতাম, তার টাটকা প্রমাণ মিলল। কলেজগুলিতে চিরকাল প্রচুর বাড়তি ছাত্র ঢোকে। এ বার করা হয়েছে, আসনসংখ্যা খাতাকলমে কিছু বাড়বে, কিন্তু অতিরিক্ত এক জনও ভর্তি হবে না। এত দিন যদি ৫০টি আসনে ১০০ জন ভর্তি হত, এ বার আসন থাকবে ৭৫, ভর্তিও হবে তাই।
উচ্চমাধ্যমিকে পাশের সংখ্যা বছর-বছর বাড়ছে, বেড়েই চলবে। পাশ করে সব ছেলেমেয়ে কলেজে ঢুকবে তা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর, প্রত্যেক স্তরে কিছু ছাত্র পাশ করে কর্মক্ষেত্রে ঢুকবে, বাকিরা মেধার ভিত্তিতে ও ভবিষ্যৎ পেশার চাহিদায় আর এক ধাপ পড়তে যাবে, এটাই যুক্তিযুক্ত। বাস্তব বলে, এই অগ্রসরে মেধার চেয়ে বিত্ত ও শ্রেণি-অবস্থান বেশি কাজ করে। এর প্রতিকার হতে পারে স্কুলব্যবস্থার উন্নতির দ্বারা, যাতে গরিব অনগ্রসর শ্রেণির ছেলেমেয়েরাও মেধার উপযোগী শিক্ষালাভ করে। সেই সঙ্গে অবশ্যই দরকার যথেষ্ট কর্মসংস্থানের, যাতে প্রত্যেক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে কিছু ছেলেমেয়ে উপযুক্ত কাজের হদিশ পায়; নইলে পরবর্তী স্তরের ক্লাসঘর ভরবে নিরুৎসাহ বীতশ্রদ্ধ তরুণের দলে। তাদের অধিকাংশ মোটামুটি একই মেধার, মার্কশিটের ভিত্তিতে কে ঢুকবে কে ঢুকবে না বাছা দুষ্কর। অতএব ঠেলাঠেলি হানাহানি, রাজনৈতিক বা নিছক আর্থিক দুর্নীতি, যার শিকার হবে কিছু উচ্চমেধার ছাত্রও।
সমস্যা মোকাবিলায় ফি-বছর উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রসংখ্যা অনুসারে চাই আগে থেকে কলেজ ব্যবস্থা প্রস্তুত করা: সম্ভাব্য সংখ্যার অনুপাতে শিক্ষক ও পরিকাঠামোর সংস্থান করে, প্রয়োজনে আরও অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করে। আমাদের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নিছক সারস্বত স্বার্থে এত পরিশ্রম করবেন, আশা করা অবাস্তব। কিন্তু ভর্তির প্রক্রিয়াটা অন্তত খাতাকলমে যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, প্রবেশপ্রার্থীরা বিভ্রান্ত বা হেনস্তা না হয়, প্রকট অনাচার এড়ানো যায়, সেটুকু চাওয়া বোধ হয় অসংগত নয়।
বিপুল পরিমাণ তথ্য স্বচ্ছ ও নির্ভুলভাবে ঝেড়ে-বেছে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওয়ার জন্য একটি পরিচিত যন্ত্র আছে, তার নাম কম্পিউটার। রেলের আসন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে অশেষ ক্ষেত্রে এর দৌলতে দেশবাসীর সময় বাঁচছে, হয়রানি কমেছে, দুর্নীতি সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে দূর হয়েছে। রাজ্যের বর্তমান শাসকদল ক্ষমতায় এসে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছিলেন। ২০১৩’য় পরীক্ষামূলক ভাবে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল হওয়ার পর ২০১৪-য় রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করার আয়োজন যখন পাকা, তখন ভর্তি শুরুর এক সপ্তাহ আগে তা প্রত্যাহার হল। ফিরে এল প্রত্যেক কলেজে আলাদা ভর্তির ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থার সুবিধাগুলি বহুচর্চিত। সবচেয়ে বড় সুবিধা, এতে স্থানীয় চাপ, প্রভাব, আন্দোলন বা দুর্নীতির অবকাশ থাকে না। সব প্রার্থীর, ও তাদের মধ্যে সফল প্রার্থীদের, নাম-নম্বর ওয়েবসাইটে তুলে দিলে (শুধু প্রথম দফায় নয়, শেষ আসনটি পূরণ হওয়া অবধি) কারচুপির প্রশ্ন নেই। কোন ছাত্র কোন কলেজে কোন বিষয়ে সুযোগ পাবে, তার পছন্দ অনুসারে কম্পিউটারই বলে দেবে, সশরীরে কাউন্সেলিং-এর দরকার হবে না: এতে হুমকি ও দুর্নীতি রোধ ছাড়া সময়ও বাঁচবে প্রচুর। পাঁচ জায়গায় পাঁচ বার ভর্তি হতে লাগবে না, অতএব শেষমেশ চারটি আসন খালি রয়ে গেলেও বিক্রি হতে পারবে না। রেজিস্ট্রেশনের কাজটা সঙ্গে-সঙ্গে হয়ে যাবে, তাতে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের স্বস্তি। দু-এক রকম কারচুপির অবকাশ তা-ও থেকে যাবে (অনুমেয় কারণে ব্যাখ্যা করছি না), কিন্তু মোটের উপর প্রক্রিয়াটা হবে সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত।
তার বদলে প্রত্যেক কলেজে আলাদা ভর্তির পাট থাকলে এক কথায় এই সব সুবিধা নাকচ হয়ে তার বিপরীত অসুবিধা-অনাচার জেঁকে বসবে, বসেছে বলেও বিস্তর অভিযোগ। এটিকে অনলাইন ব্যবস্থা বললে তঞ্চকতা হয়, কারণ তথ্যগুলি জাবদা খাতার বদলে কম্পিউটারে তোলা হচ্ছে এই মাত্র। আসল বাছাই হচ্ছে আগের মতো মানবীয় স্তরে। ঘটুক না ঘটুক, চাপ হুমকি দুর্নীতি রাজনীতি সব কিছু আগের মতোই সম্ভব। গোড়ায় একটা তালিকা যদি বা ওয়েবসাইটে ওঠে, কিছু ছাত্র সোজাসুজি ঢোকে, খালি-থাকা আসনগুলির পরবর্তী ইতিহাস উহ্য থাকে। খুব উঁচু নম্বর-পাওয়া ছেলেমেয়ে আর ক’জন? বাকিরা উৎকণ্ঠায় থাকে, নাম উঠলে দুর্নীতি নিয়ে নালিশ করা দূরের কথা, ধন্য হয়ে যায়, যদিও হয়তো ঢুকছে নম্বরের জোরে। হিংসা-হেনস্তার ভয় তো আছেই। যেমন বিশ বছর আগে তেমনই আজও, ছাত্র মায় অনেক মাস্টার নানা দুঃখের কাহিনি বলে মিনতি করেন, ‘দোহাই স্যর, নাম করবেন না, বিপদে পড়ব।’ সর্বদা বিপদ না-ও হতে পারে, মনে ভয় ঢুকে গেলেই দুরাত্মার বাজিমাত।
কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থা বাতিল করার সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, কলেজগুলির স্বাধীনতা তিনি কেড়ে নিতে পারেন না। তাঁর প্রশাসনকালে অন্য প্রতিটি উক্তি ও সিদ্ধান্ত এই নীতির এত প্রবল বিরোধী যে কৌতূহল হয়, হঠাৎ ওই ব্যতিক্রমী সংকল্প হল কেন। আরও কৌতূহল এই জন্য যে কলকাতার কয়েকটি অভিজাত প্রতিষ্ঠান বাদে প্রাক-স্নাতক ভর্তি সর্বত্র হয় উচ্চমাধ্যমিকের নম্বরের ভিত্তিতে, কলেজগুলির স্বাধীন সিদ্ধান্তের অবকাশ নেই। এমন বিধানের পর ভর্তির বাজার যে চড়তে থাকবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, যেমন নেই অনাচারের অভিযোগ বেড়ে চললে। পঠনপাঠনেও চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা ঘটতে বাধ্য। এ বছর মালদহে যে ছেলেমেয়েরা স্থানাভাবে সাইকেল শেডে পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ভর্তি সেই ২০১৪-য়। এত দিনে কর্তৃপক্ষ ক্ষতিটা খানিক স্বীকার করেছেন, কিছু তর্জনগর্জন শোনা যাচ্ছে; কিন্তু দৈত্য এক বার ছাড়া পেলে তাকে বোতলবন্দি করা কঠিন, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে কলেজগুলি খবরে উঠছে না, সেখানে অবস্থা ভাল না আরও খারাপ সে প্রশ্নও মনে জাগে।
কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে কার দোষ, তা পরের কথা। এমন অবস্থায় চাইলেও কোনও অধ্যক্ষের ঠিক পথে চলা মুশকিল, ঠিক পথ ঠিক করাই অসুবিধা। রাজ্য জুড়ে এই বিভ্রাট আর অনাচারের দায় উচ্চতর কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। একমাত্র সমাধান হতে পারে কেন্দ্রীয় অনলাইন ব্যবস্থা। সেটা কেন চালু হচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা রাজ্যবাসী দাবি করতে পারেন।
বিশেষ-বিশেষ বিভ্রাট আর অনাচার, সংখ্যায় যতই হোক না কেন, এই অবস্থার সবচেয়ে বিষময় ফল নয়। সেটা হল, কলেজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে জনমানসে নতুন ক্ষোভ আর হতাশা সৃষ্টি, কালে-কালে তা-ও দূর হয়ে অনাচারটাকে দস্তুর বলে মেনে নেওয়া, যেমন কোনও কোনও দফতর বা প্রতিষ্ঠানে বহু দশক বা শতক ধরে হচ্ছে। সেই গা-সওয়া ভ্রষ্টাচারের গ্লানি পঠনপাঠনকে আক্রান্ত করতে বাধ্য।
কত ছাত্র অন্যায় ভাবে ভর্তি হচ্ছে জানা অসম্ভব; তর্কের খাতিরে ধরা যাক, এক জনও নয়। অতিরিক্ত ভর্তি যে প্রচুর হয়েছে ও হয়ে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই। এটাও ধরে নেওয়া যায়, কিছু লোক ঘোলা জলে মাছ ধরছে যাদের সঙ্গে কলেজগুলির বৈধ-অবৈধ কোনও সম্পর্কই নেই, তারা বাইরে থেকে নেহাত ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা উপায় করছে। এমন সম্ভাবনা হিসাবে চলে আসছে, শিক্ষার সর্বনাশের পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। আগের রাজত্বে স্কুলশিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতি হয়েছে, সারা দেশের সামনে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের মুখ পুড়েছে; কলেজ শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি কম হয়নি; কিন্তু ছাত্র ভর্তি নিয়ে এত ব্যাপক অনাচারের রব ওঠেনি। তার পরিণাম আরও হানিকর, কারণ এতে সিনিসিজমের শিকার হচ্ছে সরাসরি ছাত্রেরা।
গত ভর্তির মরশুমে আমার এক সহকর্মী বাসে যাচ্ছিলেন। পাশে-বসা তরুণটি অনর্গল মোবাইলে কথা বলে গেল, কোন কলেজে কোন বিভাগে ভর্তির কত মাশুল, কী ভাবে দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করায় নিঃসংকোচে বলল সে নিজে গত বার এই পথে ভর্তি হয়েছিল, এ বার এ ভাবে লেখাপড়ার খরচ তুলছে, অন্য ছেলেমেয়েরা যেমন টিউশন পড়ায়।
সহকর্মীর মনে সবচেয়ে দাগ কেটেছিল ছেলেটির সারল্য: হাবভাব মোটেই উঠতি মাফিয়াবাজের মতো নয়, সাধারণ ঘরের পাঁচটা রোগা ভালমানুষ ছেলের মতো। প্রকৃতপক্ষে সে এখনও তা-ই, কালে কী হবে প্রশ্ন। তার প্রজন্মের বড় অংশ শিক্ষাব্যবস্থার এই দশা স্বাভাবিক ও নির্দোষ বলে মেনে নিচ্ছে: অপরাধবোধের প্রশ্নই ওঠে না, নিজেরা প্রতারিত বা শোষিত হচ্ছে ভেবে তারুণ্যসুলভ ক্ষোভটুকুও নেই। এদের অনেকে বংশে প্রথম কলেজে ঢুকছে: চৌকাঠ পেরোবার আগেই মনে গেঁথে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার এই ভাবমূর্তি— অন্যায় বলেও নয়, স্বাভাবিক দস্তুর বলে। ফলে শিক্ষক যতই দরদি নিষ্ঠাবান হন, তাঁর সাধ্য কী এই ছেলেমেয়েদের মানুষ হতে শেখাবার?
কয়েক মাস আগে আমার বাড়ি রঙ হচ্ছিল। খুব আনন্দ হল যখন এক কারিগর বললেন তাঁর মেয়ে কলেজে পড়ে, কন্যাশ্রীর ২৫,০০০ টাকা পেয়েছে। বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল পরের কথাটা শুনে: টাকাটা খুব কাজে এসেছে কলেজ-ভর্তির খরচ মেটাতে। মেয়েটি যে কলেজে যে বিষয় পড়ে, তাতে ভর্তির সময় লাগার কথা হাজার তিনেক টাকা।
কন্যাশ্রী অসাধারণ প্রকল্প, আমাদের গর্বের ধন। তার অনুদানের এই উপকারিতা শুনে সে দিন সত্যি বড় খারাপ লেগেছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক