সচেতনতা ও সক্রিয় প্রশাসনই ক্রেতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে

ক্রেতার সচেতনতার উপরে প্রশাসনিক সাফল্যও অনেকাংশে নির্ভর করে। দক্ষতা, কার্যকারিতা, নৈতিকতা, সাম্য, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বাড়লে মানুষ প্রশাসনের প্রতি আস্থাশীল হবেন। এর ফলে প্রতিযোগিতা মূলক বাজার সৃষ্টি হলে সরকারও উপকৃত হবে। লিখছেন দেবব্রত মণ্ডল

Advertisement

দেবব্রত মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১৭
Share:

‘সচেতন ক্রেতা, সুরক্ষিত ক্রেতা’— এটাই ছিল ক্রেতা সুরক্ষা আন্দোলনের শ্লোগান। ক্রেতা সুরক্ষার ধারণাটির উৎপত্তি হয় আমেরিকায়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে রালফ নাদেরের নেতৃত্বে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই বিষয়ে নীতি ও নির্দেশিকা গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভারতে ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন’ প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১, ১৯৯২, ২০০২ এবং ২০১৫ সালে এই আইনের সংশোধন করা হয়। ১৯৮৬ সালে বিচারের বা প্রতিকারের সময়সীমা ধার্য ছিল না। ২০০২ সালে সময়সীমা তিন মাস, পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে পাঁচ মাস ধার্য করা হয়।

Advertisement

বর্তমানে ক্রেতা সুরক্ষার মামলায় জেলা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরে বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। কুড়ি লক্ষ টাকা পর্যন্ত জেলাস্তরে, কুড়ি লক্ষের বেশি হলে রাজ্যস্তরে এবং এক কোটির উপরে হলে জাতীয় কমিশনে বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই আইনের যাতে অপপ্রয়োগ করা হয় না হয় সে দিকে নজর রেখেও কয়েকটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। অহেতুক বিক্রেতাকে নাকাল বা হয়রানির চেষ্টা করলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ক্রেতা বা বিক্রেতা যেই প্রতারিত হোক না কেন তার জন্য ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ণয় করা হয় দামের অনুপাতিক হারে। এই ধারায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ‘ক্যাশ মেমো’, ‘ওয়ারেন্টি কার্ড’ ইত্যাদি পেশ করতে হয়।

‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন’-এ ক্রেতাদের ছ’রকমের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই ছ’টি অধিকারের মধ্যে প্রথমটি হল নিরাপত্তার অধিকার। এই অধিকার বলে, কোনও পণ্য বা সেবা ক্রেতার কোনও রকম ক্ষতি করবে না, এই নিরাপত্তা দিতে হবে। কোনও দ্রব্য থেকে এই ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সেগুলি বিক্রি করায় যাবে না। দ্বিতীয় হল, তথ্য জানার অধিকার। এই অধিকার অনুসারে, পণ্যের গুণ বা দাম অবশ্যই ক্রেতাকে জানাতে হবে। ক্রেতা তাঁর পছন্দ মতো জিনিস কিনবেন। তৃতীয় হল পছন্দমতো সামগ্রী বাছাই করার অধিকার। এই অধিকার অনুসারে, বিক্রেতাদের মধ্যে ন্যায্য প্রতিযোগিতা থাকবে এবং ক্রেতারা পণ্যগুলির মধ্যে একটি সামগ্রী পছন্দ করে কিনবেন। চতুর্থত, বক্তব্য পেশের অধিকার। এই অধিকার অনুসারে, যদি পণ্য সামগ্রী কেনাবেচার সময় ক্রেতা মনে করেন যে তিনি অন্যায় বা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তা হলে উপভোক্তা ফোরামে তাঁর নিজের বক্তব্য পরিবেশনের অধিকার রয়েছে। পঞ্চমত, ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অধিকার। এই অধিকার অনুসারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং তা প্রমাণিত হলে বিক্রেতাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে ক্রেতাকে। ষষ্ঠত, শিক্ষার অধিকার। বিভিন্ন ধরনের কারবারের রীতি ও তার প্রতিকার সম্পর্কে ক্রেতার অবহিত হওয়ার অধিকার রয়েছে।

Advertisement

কেন্দ্রে ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ক দফতর তৈরি হয় ১৯৯১ সালের জুন মাসে। দেশের অন্য রাজ্যগুলির মতো পশ্চিমবঙ্গেও ক্রেতাসুরক্ষা বিষয়ক দফতর রয়েছে। আমরা কোনও কিছু কিনতে গিয়ে প্রথমে দেখি পণ্যের দাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই জিনিসটি কতটা টেকসই, কত দিন আগে তৈরি এবং তৈরির কত দিনের মধ্যে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে সে সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্রেতা খোঁজও করেন না। অনেকের অভিযোগ, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির বিক্রেতা নিম্নমানের সামগ্রী ক্রেতাদের ‘গছিয়ে’ দেন। অনেক সময়ে ‘ছাড়’ ইত্যাদি দিয়েও বাজে পণ্য বিক্রির অভিযোগ ওঠে। বিক্রেতাদের একাংশ এই পন্থা অবলম্বন করে নিজেদের সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের লক্ষ্য পূরণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। অনেক সময় চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও বিপণন পদ্ধতিও অযোগ্য জিনিসের বিপণনের কৌশল হয়ে দাঁড়ায়।

বড় বেসরকারি হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, নির্মাণ সংস্থা বা প্রোমোটারের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সবথেকে বেশি ওঠে। অনেক জায়গায় আর্থিক ঋণদানকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ঋণ দেওয়ার সময়ে গ্রাহকদের শর্ত সম্পর্কে ঠিক ভাবে না জানানোর অভিযোগও ওঠে। অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতাদের ফাঁকা ফর্মেও সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে এই স্বাক্ষর করা কাগজ এই সংস্থাগুলির আইনি রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের দায়ও কম নয়। কারণ, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়াভাবে অথবা অতি উৎসাহে সব ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’ বা শর্তগুলি ভাল ভাবে না পড়েই চুক্তির কাগজে স্বাক্ষর করে দেন। আবার গ্রাহকদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন যাঁদের অক্ষরজ্ঞান ঠিকমতো না থাকায় তাঁরা এই সবক’টি শর্ত ভাল ভাবে বুঝতে পারেন না।

অর্থনীতির সূত্র অনুসারে, যাঁরা বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা দ্রব্য ব্যবসার কাজে লাগান তারা হলেন ক্রেতা আর তা নিজের ব্যক্তিগত ভোগে ব্যবহার করলে তিনি হন উপভোক্তা। তথ্য বলছে, উপভোক্তাদের ৯৭ শতাংশই পণ্য ও পরিষেবা সম্পর্কে কম ওয়াকিবহাল এবং তাঁরা কেনার সময়ে ঠিক ভাবে জিনিসের মান যাচাইও করেন না। অর্থনীতির সূত্র অনুসারে, এই অসাম্য ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আর্থিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বিজ্ঞাপনের ব্যবহারে একটা কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু ক্রেতারা ক্রমাগত প্রতারণার শিকার হতে থাকলে বাজারের কেনাবেচা কমে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ‘প্রয়োজন’, ‘অপ্রয়োজন’, ‘আপাত প্রয়োজন’ ও প্রকৃত প্রয়োজন — প্রভৃতি ক্ষেত্রে নজরদারি দরকার।

বর্তমানে ইন্টারনেট, অনলাইন মার্কেটিং ইত্যাদির কারণে পণ্য কেনাবেচায় এক নতুন পথ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝুঁকিও। ডিজিটাল ভারতের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হল ক্রেতাসুরক্ষা। ক্রেতা সুরক্ষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা নীতির একটা যোগাযোগ রয়েছে। ক্রেতা সচেতন হলে তিনি সুরক্ষিত হবেন— এটাই হল অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্র। এর ফলে পণ্যের দাম কম হবে এবং তার গুণমানও বাড়বে।

ক্রেতার সচেতনতার উপরে প্রশাসনিক সাফল্যও অনেকাংশে নির্ভর করে। দক্ষতা, কার্যকারিতা, নৈতিকতা, সাম্য, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বাড়লে মানুষ প্রশাসনের প্রতি আস্থাশীল হবেন। এক দিকে, ক্রেতাসুরক্ষাকে ঠিকমতো বাস্তবায়িত করলে প্রশাসনের প্রতিও মানুষের আস্থা বাড়বে তেমনই অন্য দিকে, ক্রেতাদের সচেতনতার ফলে প্রতিযোগিতা মূলক বাজার সৃষ্টি হলে সরকারও উপকৃত হবে। তবে ক্রেতাসুরক্ষা রক্ষায় সরকারেরও কিছু দায় রয়েছে। জাল বা ভেজাল জিনিস সম্পর্কে ক্রেতাকে সচেতন করাও সরকারি দায়িত্ব। এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে অনেকে ক্রেতাসুরক্ষা বিষয়ক জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছেন। সরকারের পাশাপাশি, বাণিজ্য ও শিল্প সংস্থাগুলিও এগিয়ে এলে ক্রেতাসুরক্ষার ভিত্তি আরও মজবুত হবে।

লেখক: কালনা মহিষমর্দ্দিনী স্কুলের অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন