প্রবন্ধ ২

চাষিরা যদি শলভাসন করেন

চৈ ত্রের দুপুরে আখের জমি কোপাচ্ছিলেন সুষেণ বিশ্বাস। সকাল থেকে সামনে ঝুঁকে কোদাল চালানোর কাজ চলে সারা দিন। মাঝেমাঝেই কোমরে তীব্র ব্যথা হয়। তখন আর সোজা হতে পারেন না একচল্লিশ বছরের এই চাষির মনে হয় কে যেন একটা বড় সাঁড়াশি দিয়ে কোমরটা চেপে ধরেছে।

Advertisement

সুব্রত গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

চৈ ত্রের দুপুরে আখের জমি কোপাচ্ছিলেন সুষেণ বিশ্বাস। সকাল থেকে সামনে ঝুঁকে কোদাল চালানোর কাজ চলে সারা দিন। মাঝেমাঝেই কোমরে তীব্র ব্যথা হয়। তখন আর সোজা হতে পারেন না একচল্লিশ বছরের এই চাষির মনে হয় কে যেন একটা বড় সাঁড়াশি দিয়ে কোমরটা চেপে ধরেছে। অনেক ক্ষণ ধরে আস্তে আস্তে কোমরটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার শুরু হয় কাজ। গত পাঁচ বছর ধরে এমনই চলছে।

Advertisement

পাশে পটল খেতে নিড়েন দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করছেন বছর তিরিশের লাল্টু সাহা। বছরখানেক ধরে একটা ব্যথায় তাঁর কোমর থেকে পায়ের আঙুল ঝিনঝিন করতে থাকে। তখন উবু হয়ে বসে কাজ করতে কষ্ট হয় তাঁর। ভয় হয়, তাঁর মায়ের মতো দশা হবে না তো তাঁরও? কোমরের ব্যথায় মা সীমাদেবী পঞ্চাশ বছর বয়স না হতেই মাঠের কাজ ছেড়েছেন। দিনে দেড়শো-দুশো টাকা রোজগার করতেন আগে, এখন আর সে উপায় নেই।

হুগলির গুপ্তিপাড়ায় গঙ্গার ধারে ফুলতলার চরে কথা হচ্ছিল। ডাক্তারদের কাছে ওঁরা যা বললেন তাতে আন্দাজ হয়, দশ জনের আট জন চাষিই কোমর ব্যথায় ভুগছেন। অকালে বন্ধ করতে হচ্ছে চাষের কাজ।

Advertisement

এক্স রে করিয়েছেন কখনও? এমআরআই হয়েছে? ওরা হাসলেন। লাল্টুবাবু বললেন, ‘বাড়ি ফিরেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ি। বাচ্চাদের বলি পিঠের উপর দিয়ে হাঁটতে। খুব বাড়াবাড়ি হলে ওষুধের দোকানদার ব্যথার বড়ি দেন। ব্যস, ওই পর্যন্ত।’ এই চাষিদের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট হয়, তাঁরা নিজেদের জীবিকা অর্জন করতে গিয়ে নিজেদের কর্মক্ষমতা নিঃশেষ করে দিচ্ছেন।

কোমরের ব্যথা জিনিসটা জীবনঘাতী নয়, তাই একে তেমন আমল দেওয়া হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু বলছে, কার্যক্ষমতা হারানোর প্রতিযোগিতায় কোমর ব্যথা পিছনে ফেলে দিয়েছে মানসিক অবসাদ, রক্তাল্পতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এমন অনেক অসুখকে। নানা পেশার মানুষদের তিন জনের এক জনই পুরনো কোমরের ব্যথায় কাবু হয়ে বাধ্য হয়ে ছুটি নেন। ভারতে চটকল শ্রমিকদের পঞ্চান্ন শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথায় ভোগেন বলে দেখা গিয়েছে। এদের অনেকে অস্ত্রোপচার করিয়েও কাজে ফিরতে পারেননি।

কোমর ব্যথার জন্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের কত ক্ষতি হয়, তার হিসেব কষা হয়েছে ইউরোপে। দেখা গিয়েছে, চিকিৎসার খরচ ছাড়াও শ্রমদিবস নষ্ট, উৎপাদন কমে যাওয়া, ক্ষতিপূরণ, এমন নানা খরচের জন্য যত টাকা নষ্ট হয়, তা অধিকাংশ মারাত্মক রোগের আর্থিক ব্যয়ভারের চাইতে বেশি। এ দেশে তেমন হিসেব কষা হয়নি। তবে হলে দেখা যাবে, কোমর ব্যথার ফলে কাজ হারানোর জন্য বহু পরিবার চলে গিয়েছে দারিদ্রসীমার নীচে। প্রশিক্ষিত শ্রমিক অকালে কাজ ছাড়লে ক্ষতি শিল্পেরও।

যাঁরা অফিসে চেয়ারে বসে কাজ করেন, তাঁদেরও প্রায় অর্ধেক কোনও না কোনও সময়ে কোমর ব্যথায় ভোগেন। তফাত এই যে প্রতিকারের উপায় খুঁজে পাওয়া এবং তা অনুসরণ করা অফিসকর্মীদের কিছুটা সাধ্যায়ত্ত, কিন্তু শ্রমিকদের পক্ষে প্রায়ই সাধ্যাতীত। তাঁদের কাজের ধরন অনুসারে তাঁদের একই দেহভঙ্গি অনেক ক্ষণ ধরে রাখতে হয়, বা একই রকম ভাবে এ পাশ ও পাশ দেহচালনা করতে হয়। ভারী ওজন তুলতে, বা টেনে নিয়ে যেতে হয়। এগুলো তাঁরা কাজের শর্ত বলেই মনে করেন। চাষ করতে হলে কোমর থেকে সামনে ঝুঁকে নিড়ান দেওয়া, কোদাল চালনা, ধান পোঁতা, কাটা, ঝাড়া, সব কাজই করতে হবে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী, তাঁরা জানেন না।

কাজের জন্য যাতে কাজের ক্ষমতা না কমে, সেই উদ্দেশে মার্কিন সরকারের শ্রমবিভাগ বিভিন্ন পেশার কর্মীদের ‘ফিটনেস ট্রেনার’ বা শরীরচর্চা প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছেন। তাঁরা কাজের চাহিদা অনুসারে শরীরকে উপযুক্ত রাখতে নানা পরামর্শ দেন এবং শরীরচর্চা শিখিয়ে দেন। এই ব্যায়ামগুলো মূলত মেরুদণ্ডের সন্ধিগুলোকে সামনে-পিছনে-ডাইনে-বাঁয়ে সচল রাখতে, পিঠের ও পেটের মাংসপেশিকে শক্তিশালী ও টানটান রাখতে শেখান। এগুলোরই নানা রকমফের মেলে আমাদের পরিচিত যোগাসনগুলিতে। ভুজঙ্গাসন, শলভাসন, পবনমুক্তাসন, গোমুখাসন, ধনুরাসন, বিদেশে এগুলিরই পশ্চিমি নানা সংস্করণ শেখানো হয়।

আমাদের দেশেও চাষিদের ব্যথামুক্তি সম্ভব, যদি কৃষি, শ্রম, স্বাস্থ্য দফতরের মধ্যে একটা সমন্বয় করা যায়। চাষি, চটকল শ্রমিক, মালবাহী শ্রমিক, নির্মাণ কর্মী, এমন নানা শ্রেণির কর্মীদের কাজ অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম দেখিয়ে দিতে পারেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষি দফতর চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়, শ্রম দফতর থেকেও শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক নানা প্রকল্প নেওয়া হয়। যোগব্যায়াম এবং ব্যথা নিবারণের উপায়গুলি তার সঙ্গে যুক্ত করা খুব কঠিন নয়। তার জন্য এমন কিছু খরচও হবে না। বিশেষজ্ঞ এবং যোগশিক্ষকেরও অভাব নেই। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর পরিকল্পনা।

ব্যথা বিশেষজ্ঞ, ইএসআই হাসপাতালের চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন