বিরোধীদের জন্য নীতিকথা একটাই: একত্র হতে হবে

যেন তেন প্রকারেণ

এই লেখা ছাপতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত কর্নাটকের চূড়ান্ত ফলাফলে ধূসরতা আছে। কংগ্রেস দেবগৌড়ার পুত্রকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা করছে বিজেপি-কে আটকাতে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:২২
Share:

সাফল্য: জয় নিরঙ্কুশ নয়, কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত। বেঙ্গালুরু, ১৫ মে। ছবি: পিটিআই

আমাদের ছোটবেলায় মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবজেকটিভ টাইপ প্রশ্ন থাকত। এক কথায় উত্তর দিতে হবে। কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আর কংগ্রেস কে কত আসনে জিতল, এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় হতে পারে। কিন্তু সব প্রশ্নের একটি বাক্যে জবাব হয় না। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ কী, এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দিতে গেলে তা অর্ধ ও আংশিক সত্য হতে বাধ্য। আজকাল কিছু সংবাদ চ্যানেলে এ হেন অবজেকটিভ প্রশ্নবাণ ছুড়ে দেন অ্যাঙ্করগণ। তবে কি বলা যায়, এ হল নরেন্দ্র মোদীর জয় এবং রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বের বিপর্যয়? এক কথায় উত্তর দিতে হবে। হয় হ্যাঁ, নয় না। হয় মোহনবাগান, না হলে ইস্টবেঙ্গল। একটা পক্ষ নিতেই হবে। এ এক ভয়াবহ বনামের রাজনীতি। কর্নাটক নির্বাচনের ফলাফলে এটা স্পষ্ট, রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ যথেষ্ট। রাহুল গাঁধী পরিশ্রম করলেন। হাই কমান্ডের দাদাগিরির সংস্কৃতি বদলে রাজ্য নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করলেন। তবু শেষ রক্ষা হল না। উল্টে দেখা গেল, মোদী-অমিত শাহ জুটি সেই সুকৌশলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফসল তুললেন।

Advertisement

একেই বলে নির্বাচন ম্যানেজমেন্ট। অর্থনীতির সঙ্গেও যেমন বহু দিন আগে ন্যায়নীতির বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, আজকের রাজনীতি থেকেও ছুটি দেওয়া হয়েছে নৈতিকতাকে। যেন তেন প্রকারেণ ব্যালটে জয়লাভই আজ শেষ কথা। মানুষের কল্যাণ, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র রক্ষার সঙ্গে এই জয়ের সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে মমতার পশ্চিমবঙ্গ— মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধানের কোনও চেষ্টা ভোট প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। উন্নয়ন বা কাবেরীর জলবণ্টনের সমস্যা, এ সব জ্বলন্ত বিষয় মুখ ঢেকে থাকে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ভোটে জেতার কৃৎকৌশল।

এই লেখা ছাপতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত কর্নাটকের চূড়ান্ত ফলাফলে ধূসরতা আছে। কংগ্রেস দেবগৌড়ার পুত্রকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা করছে বিজেপি-কে আটকাতে। তবে এটা বলা যায়, গত বারের তুলনায় এ বার কংগ্রেসের শতকরা ভোট বাড়লেও বিজেপিই হল ফার্স্ট বয়। দলের টীকাভাষ্যকাররা সকাল থেকে বলতে শুরু করেছেন এর মানে জিএসটি, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, সবই নাকি মানুষ উৎফুল্লচিত্তে গ্রহণ করেছেন। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এখন আদি ও অকৃত্রিম। ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী’ স্লোগান দিয়ে বিজেপির কর্মীরা পথে নেমে পড়েছেন দুপুরের মধ্যেই। এ সব হল অপটিক্স-এর রাজনীতি।

Advertisement

অবভাস যা-ই হোক, বাস্তবতা কী? গত চার বছরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বর্ধমান অসন্তোষ কি অসত্য? সরকারি ঢক্কানিনাদ যা-ই বলুক, বাস্তবে যে রাজ্যে রাজ্যে আর্থিক সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর। কৃষকদের আত্মহত্যা। ছোট দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস। চাকরিবাকরি নেই। বিদেশি লগ্নির চালচিত্র আজও বড় করুণ। বিজেপি এ দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টি দখল করেছে। এ বার কর্নাটক দখল হলে সংখ্যা হবে ২১। কিন্তু তাতে কি কর্নাটকের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে? চার বছরে কি ‘অচ্ছে দিন’ এল আমাদের?

এখন পৃথিবী জুড়েই ‘ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে গবেষণা চলছে। কোম্পানির চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার মোদী, কিন্তু চিফ অপারেটিং অফিসার অমিত শাহ। তাঁর ওয়র রুম আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষার এক অভিনব ক্ষেত্র। প্রধানমন্ত্রী বললেন, বিকাশ, বিকাশ ও বিকাশ, কিন্তু কর্নাটকের উপকূলবর্তী এলাকায় গত এক মাস ধরে উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার হয়েছে। সংখ্যালঘু সমাজের সঙ্গে পাক আইএসআই-এর ভূমিকাকে যুক্ত করে প্রচার হয়েছে— বিপন্ন হিন্দুত্ব।

রাহুল গাঁধীর মস্ত সমস্যা, তিনি ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি হিন্দু মন্দিরে গিয়ে বলতে চেয়েছেন হিন্দুত্ব নামক রাজনৈতিক স্লোগানটি হিন্দুধর্ম নয়। তিনিও মন্দিরে যান। কিন্তু তিনি মুসলিম-বিরোধী নন। হতেও চান না। এ তো আসলে মেরুকরণ বিরোধী মিলনের রাজনীতি। আজ গোটা দেশের জনসমাজের, এমনকী হিন্দি বলয় তথা দক্ষিণ ভারতের এক বড় অংশের মানুষ উগ্র অসহিষ্ণু সংখ্যালঘু-বিরোধী হিন্দুত্বে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। মানুষ হয়তো নিজের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার অভাববোধের জন্যই আরও বেশি করে অসহিষ্ণু উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মানসিকতার শিকার হচ্ছেন। বিজেপি সেই মানসিকতার সবচেয়ে বড় সেলসম্যান। বহু মানুষ তাঁদের প্রডাক্ট কিনছেন। প্রসঙ্গত, কর্নাটকে মঠ রাজনীতি বহু প্রাচীন। মঠের সাধুদের আছে বহু ভক্ত। আবার সঙ্ঘ পরিবারের এক পুরনো ‘বেস’ আছে। এই ক্ষমতাসীন মঠ ও সঙ্ঘ নেতাদের নির্দেশ মেনে আজও ভোট দেন রাজ্যের বহু মানুষ। অমিত শাহ কুশলী রাজনেতা, এবং চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর মা লক্ষ্মীর অশেষ কৃপা তাঁর দলের উপর।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে রাজনৈতিক হিংসার পরম্পরা আছে, কিন্তু কংগ্রেস বনাম বিজেপি লড়াই হয় যে সব রাজ্যে, সেখানে ভোটের সময় হিংসা সে ভাবে না হলেও ধর্মীয় মেরুকরণ, নানা ভাবে জাতপাতের সংঘাত হয়। বুথ দখলের দৃশ্য কর্নাটকে দেখা যায়নি, কিন্তু ভারতের ‘তথ্যপ্রযুক্তি নগরী’ বেঙ্গালুরুতে বিজেপি কাবেরী নদীর সমস্যার দ্বন্দ্ব না মিটিয়ে তিন বছরের পুরনো ঘটনা কংগ্রেসের টিপু সুলতান জয়ন্তী অনুষ্ঠানের তীব্র নিন্দা করেছে। যে নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ছিলেন দুর্নীতিবিরোধী মসিহা, বলেছিলেন, ‘ঘুষ খাব না, কাউকে খেতেও দেব না,’ সেই মোদীই দুর্নীতির দায়ে জেল খাটা ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী পদের প্রার্থী করতে বাধ্য হন। যুক্তি, তাঁর সঙ্গে আছে লিঙ্গায়ত ভোট ব্যাঙ্ক। আবার আধুনিক রাহুলের দলের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া কেন্দ্রের কাছে এই গোষ্ঠীকে পৃথক ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মর্যাদা দেওয়ার আর্জি জানান। এ বার বিজেপির পাল্টা প্রচার ছিল, সিদ্দারামাইয়া লিঙ্গায়ত নন, ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ভুক্ত— আসলে এ এক ষড়যন্ত্র। লিঙ্গায়তদের ভাঙতে চান তিনি।

তাই এই ভোটের ফল, এক জনের জয় অন্য জনের পরাজয়, এ ভাবে দেখতে চাই না। যদি ২০১৯-এর ভোটের আগে কর্নাটকে বিজেপি কংগ্রেসকে সরিয়ে সরকার গঠন করতে পারে, তবে দলীয় সমর্থক ও কর্মীদের মনোবল তারা বাড়াতে পারবে, না হলে কংগ্রেসের কিঞ্চিৎ মুখরক্ষা হবে।

তবে বিবিধ কারণ বিশ্লেষণের পর আশা করি আজ দেবগৌড়াও বুঝতে পারছেন ২০১৯ সালে যদি সত্যিই নরেন্দ্র মোদীর মতো এক ‘লেভিয়াথান’কে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়, তবে প্রয়োজন বিরোধী ঐক্য। ভোটের আগেই বিরোধী সমস্ত দলকে আরও কাছাকাছি আসতে হবে। কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল হলেও আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়েই তাকে এগোতে হবে।

ঈশপের গল্পে শেষে নীতিকথা থাকত। কর্নাটক ভোট ফলাফলের পর বিরোধীদের জন্য নীতিকথা একটাই: একত্র হতে হবে, বিভেদ মানেই পতন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন