মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু
নবান্ন
হাওড়া
শ্রীচরণেষু দিদি,
ভেবেছিলাম, বিজয়ার পরেই প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখব। কিন্তু আর স্থির থাকতে পারলাম না। টিভির খবরেও যে রগরগে সাল্লুভাইয়ের ছবির মতো অ্যাকশন দেখা যাবে, কেউ ভেবেছিল? আপনি বলেছিলেন, তেলেভাজাও শিল্প। কিন্তু সবাই তো আর তেলেভাজা তৈরি করতে পারে না! তা হলে তারা কী করবে? তাদের জন্যই আপনার এই সাল্লুভাই মডেল!
এই মিডিয়া কিছু বোঝে না। কিন্তু আমি বুঝেছি, বাঁশের মুখে সাংবাদিকরাও কেন। তার আগে বলে নিই, এই তোলা তত্ত্ব কী বুঝেছি। ভুল হলে আগের মতো ধরিয়ে দেবেন। নির্মল মাজির প্রতাপের রহস্যও তো এই হালুয়া-তোলা মডেলেরই অংশ। তাই না?
হালুয়া-তোলা মডেল টা কী? আমাদের পাড়ায় এক দাদা আছে। খুব লেখাপড়া। আপনার খুব ভক্ত। সে বলেছিল, ভাল সরকার বড়লোকদের উপর কর চাপিয়ে সেই টাকায় গরিবদের মুখে অন্ন জোগায়। বলেছিল, আমাদের দেশে নাকি রোজগারের উপর কর খালি কেন্দ্র বসাতে পারে। এ বার ভাবুন, দিদি, আপনি কী করলেন? আপনি এই তোলা মডেলকে দেশের কাজে লাগিয়ে দিলেন। কী ভাবে?
সরকার সবাইকে চাকরি দিতে পারে না। আবার রাজ্য যে বড়লোকদের কাছ থেকে কর বসিয়ে টাকা তুলে গরিবদের দেবে, তারও উপায় নেই। তাই আপনি তৈরি করলেন বাঙালি সাল্লুভাইদের। বললেন, তোলা তোল আর রোজগার কর। ভাল থাক। অর্থাৎ ঘুরিয়ে রাজ্যের আয়কর আর ভর্তুকি ব্যবস্থা। এক ঢিলে দুই পাখি।
শুনেছি আমাদের দেশে নাকি সংবিধান বলে একটা ব্যাপার আছে। তাতে নাকি লেখা আছে এই দেশে সরকার গরিবদের অধিকার দেখবে। মিডিয়া কেমন আজব জিনিস। এইটুকুন পড়াশোনাও করে না। আমি যে জিনিসটা জানি, সেটাও এরা জানে না। কিছু অপছন্দ হলেই বাচ্চা ছেলেদের মতো ‘ভাল্লাগে না’ বলে লাফাতে থাকে। তোলা তো গরিবদের ভালর জন্যই। আর একদম সাংবিধানিক।
আমি যদি বড়লোকের কাছে গিয়ে বলি টাকা দাও, সে তো ভিক্ষা। কিন্তু যদি কেউ প্রণামী দেয়? দেখুন, ঠাকুরের তো দু’রকম ভক্ত আছে। কেউ কিছু না আশা করেই প্রণামী চড়ায়। আর, কেউ খারাপ অবস্থায় ভগবানের পায়ে গিয়ে পড়ে। কিন্তু দু’জনেই চায় ভগবান যাতে রেগে গিয়ে খারাপ কিছু করে না বসে। এই তোলাও সেই রকম করে স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। ভিক্ষা নয়, হকের পাওনা। শাস্ত্রে আছে, ভগবানের সেবা করলে ভাল হয়। তোলাও সেই রকম, দিলে শান্তিতে ঘরকন্না করা যায়।
কিন্তু সব সময় সেবা চড়ালেই কি সব ভাল থাকে? ভগবান শিখিয়েছেন, যতই সেবা কর, মনে পাপ থাকলে ফল মিলবে না। তেমনই তোলা দিয়ে তুষ্ট করলেই হবে না, মন প্রাণ দিয়ে দিদির সেবা করলেই ফল মিলবে। আর তা বোঝাতেই হালুয়া মডেল।
বাঙালি শিশুদের মতো। শাসন না করলে, চট করে শক্তির মাহাত্ম্য বুঝতে চায় না। এমনকী এই মিডিয়াও বুঝতে চায় না। কারণ এরা চাঁদ সদাগরের গল্প জানে না। ইংরেজি স্কুলে পড়ে কি এসব বোঝা যায়? চাঁদ ছিল শিবের উপাসক। সেও বাধ্য হয়েছিল মনসার উপাসনা করতে। সে কি এমনি হয়েছিল? মনসার রোষে গোটা পরিবার হারিয়েও সে বুঝতে চায়নি, এমনই গোঁয়ার ছিল সে। কিন্তু তাকেও মাথা নোয়াতে হয়েছিল অবশেষে ওই হালুয়া মডেলেই।
বাঙালি তিন দশকের উপর বাম হালুয়ায় কাত ছিল। কিছুতেই বুঝতে চাইত না, অন্যেরও সেই শক্তি থাকতে পারে। দিদি, আপনার কত বছর লেগেছিল বোঝাতে যে বাম যা পারে, আপনি তা আরও ভাল পারেন? সিঙ্গুর নিয়ে মিডিয়ার কত তত্ত্ব। কিন্তু মোদ্দা কথা হল সেই হালুয়া মডেল। তবেই না ২০১১ ঘটল। কিন্তু চাঁদ ছিল একা। রাজ্য জুড়ে তো কোটি কোটি চাঁদ। তাই হালুয়া মডেলের দু’টো অংশ— জন, আর গণ। জন হল ব্যক্তি ‘ক্যালাও’ মডেল। শব্দটা খারাপ হল, কিন্তু কথাটা বুঝলেন তো? মডেলটা হল, পাড়ার টেড়া লোককে সিধা করতে প্রথমে বোঝাও। তারপরে ধমকাও, তাতেও না হলে বাইক বাহিনী পাঠাও। বাড়ির চারিদিকে আওয়াজ করে ঘুরবে। তাতেও না হলে, ক্যালাও। ভোটের বাজারে অন্য মডেল। চটঘেরা ঘুপচিতে কে কখন কোন বোতামটা টিপে দেয়, ভরসা আছে? তাই গোড়া থেকে চমকে রাখতে হয়। এটা হল গণ মডেল। বলা তো যায় না, কখন কেস উল্টি হয়ে সিপিএম হয়ে যায়!
তো মিডিয়া কেন? এটা সোজা। দু’চারটেকে বেধড়ক দিলেই বাকিগুলোও গুটিয়ে যাবে। আর তা ছাড়া মিডিয়া বড় গণতন্ত্র কপচায়। চেপে দাও। আরে বাবা জনতা তো আমাদের সঙ্গে, তারাই তো গণ। এটা তো তাদেরই তন্ত্র। তা হলে তোদের এত ফড়ফড়ানি কিসের বাপু? তাই এত লাঠিসোটা, স্পাইডারম্যানের মতো পাঁচিল থেকে ঝাঁপের মতো রগড়। ছবি দেখে আম-পাবলিক ভড়কে গেলে ডবল লাভ।
এই হল আমার বোঝার হালুয়া-তোলা মডেল। খালি একটাই ভয়, এই জন আর গণ তন্ত্রের রক্তবীজ এখন তো নাচছে ভাল। যদি উল্টো পাক দেয়?
প্রণাম নেবেন।
আপনার একান্ত অনুগত,
বেকুব