বিরোধীরা ভুল বলেন নাই। সংসদের সিদ্ধান্ত লইবার প্রক্রিয়াটি যদি গণতন্ত্রের টুঁটি চাপিয়া ধরে, তবে সেই দিনটিকে ‘কালা দিবস’ বলাই সঙ্গত। তথ্যের অধিকার আইনে যে সংশোধন লোকসভায় পাশ করাইল নরেন্দ্র মোদী সরকার, তাহাতে গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শ বিপন্ন, বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। রাজ্যসভা এই আইন রুখিতে পারিবে কি না, ভবিষ্যৎ বলিবে। কিন্তু লোকসভার যে সদস্যরা তথ্য কমিশনের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করিবার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, তাঁহারা গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সম্মান দেখাইলেন না, ইহা নিশ্চিত। তথ্যের অধিকার আইনটি অত্যন্ত জরুরি ও শক্তিশালী একটি অস্ত্র ছিল— সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বৈষম্য, কর্তব্যে অবহেলা প্রভৃতির সহিত নাগরিকের মোকাবিলার অস্ত্র। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে নাগরিকের ন্যায় পাইবার উপায়। তথ্যের অধিকারের রাজনৈতিক শক্তিও কম নহে। জাতীয় তথ্য কমিশন এবং বিবিধ রাজ্য তথ্য কমিশনে যে সকল আবেদন জমা রহিয়াছে, তাহাতে প্রকাশ পাইতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে প্রধান ঋণখেলাপি ব্যক্তিদের নাম, নির্বাচিত নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, খনিজসম্পদ উত্তোলনের অনুমোদনপ্রাপ্ত কর্পোরেট সংস্থাদের নাম ইত্যাদি। এমন সব তথ্য প্রকাশ পাইবার সম্ভাবনা দেখিলে প্রভাবশালী ও বাহুবলীরা হিংস্র হইয়া ওঠেন। আর সেই জন্যই তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলিতে পারে। এক বিরোধী সাংসদ লোকসভায় উল্লেখ করিয়াছেন যে, তথ্যের অধিকার নামক অস্ত্রের ভয়ে তিরাশি জন আন্দোলনকারীকে ইতিমধ্যে খুন করা হইয়াছে, দেড়শতেরও অধিক মানুষকে আহত করা হইয়াছে। ‘স্বচ্ছ ভারত’ গড়িবার কাজটি বিপজ্জনক, সন্দেহ নাই।
এত দিন তথ্যের অধিকার আইন অনুসারে জাতীয় তথ্য কমিশন এবং রাজ্য তথ্য কমিশনগুলির সদস্যদের পাঁচ বৎসরের কার্যকাল, এবং তাঁহাদের বেতন, ভাতা প্রভৃতি ছিল বিধিনির্দিষ্ট। এই সকল বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সমমর্যাদা পাইয়াছিল তথ্য কমিশন। আইন সংশোধিত হইলে সদস্যদের কার্যকাল, বেতন প্রভৃতি সকলই নির্দিষ্ট করিবে কেন্দ্র। ইহা সহজেই অনুমেয় যে, সদস্যদের কাজের শর্তাবলি আইনের দ্বারা সুরক্ষিত থাকিলে তাঁহাদের নির্ভয়ে, নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করিবার যে পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব, শর্তগুলি সরকার নির্ধারণ করিলে সেই নিরপেক্ষতার পরিবেশ ব্যাহত হইবে। অতএব প্রস্তাবিত সংশোধন কেবল প্রশাসনিক নিয়মে পরিবর্তন নহে, কমিশনের স্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ। একই কৌশলে, অর্থাৎ সদস্যদের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করিয়া, মানবাধিকার কমিশনের স্বাতন্ত্র্যকেও লঘু করিতে সংশোধনী আনিয়াছে সরকার। ইহাও আপত্তিকর যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো লঙ্ঘন করিয়া রাজ্য তথ্য কমিশনেও সদস্য নিয়োগ করিতে চাহে কেন্দ্র। অর্থাৎ এই সংশোধনীতে রাজ্য সরকারগুলির স্বাতন্ত্র্যও আহত হইবে। তথ্য প্রকাশে সরকারের অনীহা থাকা অনুচিত হইলেও আশ্চর্য নহে। কিন্তু তাহার জন্য একটি স্বতন্ত্র, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে সরকার এই ভাবে সম্পূর্ণত নিয়ন্ত্রণাধীন করিতে গেলে তাহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হইয়া পড়ে।
তবে ‘কালা দিবস’-এর কালিমা বিরোধীদের গায়েও কি লাগে নাই? তাঁহারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করিয়া সংসদে বক্তৃতা করিয়াছেন, কিন্তু তথ্যের অধিকার আইন বা মানবাধিকার আইনে সংশোধন আটকাইতে পারেন নাই। প্রশ্ন শুধু সংখ্যার নহে, কৌশলেরও। তৃণমূল সাংসদরা অভিযোগ করিয়াছেন, সংসদে সরকার আলোচনার যথেষ্ট সময় না দিয়া বিল পাশ করাইতেছে। কিন্তু আলোচনায় সরকারকে বাধ্য করিবার দায়টিও কি বিরোধীর নহে? সরকার বিল পাশ করাইতে নানা কৌশল করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। সংসদের ভিতরে ও বাহিরে প্রতিরোধ করিবার কাজটি বিরোধীর। ইহা ভুলিলে চলিবে না।