সম্পাদকীয় ১

অনুপস্থিত

এমন অনুপস্থিতি যে ব্যতিক্রম নহে, ঘটনাচক্রে সেই দিনই তাহা বিজেপির এক সাংসদ তুলিয়া ধরিয়াছেন লোকসভায়। তিনি বরুণ গাঁধী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share:

প য়লা অগস্ট রাজ্যসভায় যাহা ঘটিল, তাহা ভারতীয় সংসদের মাপকাঠিতেও চমকপ্রদ। শাসক দলের মাত্র বাহান্ন জন সাংসদ উপস্থিত থাকায় বিরোধীরা একটি প্রস্তাবিত আইনে সংশোধন পাশ করাইয়া লইল। যেমন-তেমন আইন নহে, সংবিধানের সংশোধনী। পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য জাতীয় কমিশনের গঠনের শর্তাবলি সংক্রান্ত আইনটি লোকসভায় ইতিমধ্যেই পাশ হইয়াছে, রাজ্যসভায় সংশোধনের জেরে বিলটি ফের যাইবে লোকসভায়। সরকার ইহাতে বিব্রত, প্রধান শাসক দল অপদস্থ। দলের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ সত্ত্বেও যে বিজেপি সাংসদরা অনুপস্থিত ছিলেন, তাহা দলের সভাপতি অমিত শাহের বজ্রকঠোর ভাবমূর্তিতে আঘাত করিয়াছে। কিন্তু বিষয়টি দেশের মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা অপমান ও আশঙ্কার। তাঁহারা নির্বাচনে যে দলকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়াছেন, শৃঙ্খলাহীনতার কারণে তাহা কার্যক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতে পরিণত হইল। ভোটে জিতিয়া আইনসভায় হারিল বিজেপি ও তাহার সহযোগীরা। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যদি সরকার পক্ষ খারিজ হইয়া যায়, তাহা হইলে সংসদীয় গণতন্ত্রই প্রহসন হইয়া দাঁড়ায়। আলোচনার দ্বারা আইন করিবার যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, নানা স্বার্থের তুল্যমূল্য বিচার করিয়া সিদ্ধান্তগ্রহণের যে বিধি, তাহা এক রকম ভুলিয়াছে সংসদ। সাংসদদের অনুপস্থিতি এবং অনাগ্রহ তাহার প্রধান কারণ।

Advertisement

এমন অনুপস্থিতি যে ব্যতিক্রম নহে, ঘটনাচক্রে সেই দিনই তাহা বিজেপির এক সাংসদ তুলিয়া ধরিয়াছেন লোকসভায়। তিনি বরুণ গাঁধী। ভারতীয় জনতা পার্টির এই সাংসদ বলিয়াছেন, একচল্লিশ শতাংশ বিল আলোচনা না করিয়া পাশ করিয়াছে বর্তমান সংসদ, তাহাতে সংসদের প্রয়োজনই খারিজ হইয়া যায়। বরুণ আরও মৌলিক একটি প্রশ্ন তুলিয়াছেন। সাংসদরা যদি তাঁহাদের জন্য নির্দিষ্ট কাজটি না-ই করেন, তবে তাঁহাদের বেতন বাড়াইবার কী যুক্তি থাকিতে পারে? গত এক দশকে চারশো শতাংশ বেতন বাড়িয়াছে সাংসদদের। অথচ সংসদের কাজের দিন ক্রমশ কমিতেছে। ১৯৫২ সালে ১২৩ দিন লোকসভা বসিয়াছিল, ২০১৬ সালে বসিয়াছে ৭৫ দিন। বস্তুত, ১৯৫০-এর দশকে লোকসভার অধিবেশন বসিয়াছিল বছরে গড়পড়তা ১২৭ দিন। কোথা হইতে আমরা কোথায় পৌঁছাইয়াছি! বিতর্কহীন আইন প্রণয়নের বিষয়ে তাঁহার বিদায়ী ভাষণে সতর্ক করিয়াছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। সংসদ আইন পাশ না করিতে পারিলে, অথবা আলোচনা না করিয়াই আইন পাশ করিলে, তাহা দেশের মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। মতের বিরোধিতা রূপ পাইবে সভাকক্ষের বিতর্কে, সভা মুলতুবিতে নহে, এমনই আশা তাঁহার।

গোলমাল বিরোধীরা করেন বটে, কিন্তু সরকার পক্ষের দায় কম নহে। মোদী এবং শাহ বিজেপি সাংসদদের তিরস্কার করিতে পারেন। কিন্তু আলোচনা যে নিষ্প্রয়োজন, সে বার্তা কি তাঁহারাই দেন নাই? মোদী বিমুদ্রাকরণের মতো গুরুতর বিষয়েও সংসদের বিতর্কে অনুপস্থিত ছিলেন। যে কোনও বিষয়েই বিরোধীদের উত্তর দিতে তিনি অনাগ্রহী, সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন শুনিতেও নারাজ। মোদী বিশ্বাস করেন ভাষণে। তাঁহার নিকট এই বার্তাই মেলে যে, নির্বাচন জিতিবার পর আর প্রশ্নের জায়গা নাই। অতএব সাংসদরাই বা বৃথা কালক্ষেপ করিবেন কেন? নির্বাচনের সহিত আইন প্রণয়ন, আইনের সহিত নীতি, এবং নীতির সহিত উন্নয়নের যোগটি ক্রমশ অস্পষ্ট হইয়াছে। আইন ও নীতি নির্ধারণের বিষয়টি কতিপয় বিশেষজ্ঞের উপর ন্যস্ত করিয়া সাংসদরা সংসদকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের মঞ্চ বানাইবেন, ইহাই এখন প্রত্যাশিত। আলোচনার দ্বারা প্রশাসন এখন রাজনীতির পাঠ্যবইয়ে পর্যবসিত হইয়াছে। তাহা পালনের লোক নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন