অপরাধ, ব্যবসা ও রাজনীতি

সিদ্দিকুল্লা সাহেব কি বোঝেন না, তাঁর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের আবহকে আরও জ্বালানি জোগাবে? আর তাতে হিন্দুত্বের রুটি সেঁকবে বিজেপি?

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

অন্ধভক্তি-রস: আদালতের রায় জানার অপেক্ষায় ডেরা সচ্চা সৌদায় গুরমিত রাম রহিমের ভক্তবৃন্দ। পঞ্চকুলা, ২৩ অগস্ট। ছবি: পিটিআই

ছি সিদ্দিকুল্লা সাহেব।— সুপ্রিম কোর্ট যখন তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায় দিল, তখন আপনি, রাজ্যের গ্রন্থাগার ও গণশিক্ষা মন্ত্রী, বলে বসলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অসাংবিধানিক? আমি ইসলাম বা শরিয়ত বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু সিদ্দিকুল্লার মন্তব্য শুনে ঢাকার কামিয়াব প্রকাশনের অধ্যাপক গোলাম আযমের ‘বিয়ে-তালাক-ফারায়েজ’ শীর্ষক পুস্তকটি পড়ে ফেললাম। দেখলাম, সেখানে উল্টে লেখক বলছেন, তালাকের ব্যাপারে মুসলিম সমাজে বেশ কিছু কুপ্রথা-কুসংস্কার আছে যা থেকে বাঁচাতে কাজি সাহেবেরা বিশেষ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আরও বলা হয়েছে, রাগের মাথায় তিন তালাক কুপ্রথা। শরিয়তসম্মত পদ্ধতি নয়।

Advertisement

সিদ্দিকুল্লা সাহেব কি বোঝেন না, তাঁর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের আবহকে আরও জ্বালানি জোগাবে? আর তাতে হিন্দুত্বের রুটি সেঁকবে বিজেপি? না কি বোঝেন, তবু আধুনিক মুসলিম মন বিকশিত হোক সেটা চান না?

আমরা এখন এক ত্রস্ত সময়ের মধ্যে বসবাস করছি। বড় দুঃসময়। এক দিকে প্রগতির রথ এগোচ্ছে, অন্য দিকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ গুরুবাদ। এক দিকে আধুনিকতা, অন্য দিকে পশ্চাৎমুখিতা। স্কিৎজোফ্রিনিয়া— রোগীদের বর্হিমন আর অন্তর্মনের সংঘাত। ভারতীয় সমাজও এখন ‘সাংস্কৃতিক স্কিৎজোফ্রিনিয়া’ নামক মারাত্মক এক অসুখে আক্রান্ত। প্রয়াত সমাজতাত্ত্বিক শ্রীনিবাসন এই অসুখের আবিষ্কারক। এই যে আমরা হরিয়ানায় গুরমিত রাম রহিম সিংহের তথাকথিত ভক্তদের তাণ্ডবলীলা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছিল, এটাই কি সেই নতুন আধুনিক ভারত যার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী? দেড় কোটি ভক্ত। ২০১৭ সালের ভারতে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া একটি মানুষের পক্ষ নিয়ে এহেন গণ উন্মাদনা, এমন বেপরোয়া ভক্তিরস? অকল্পনীয়।

Advertisement

আমি হিন্দু। সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতোই শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামীজির ভাবনার আবহে বড় হয়েছি। এমন ধর্মীয় উন্মাদনা উত্তর ভারতে হিন্দি বলয়ে দেখেছি, কিন্তু আমাদের বাংলায় দেখেছি অনেক কম। গুরুগীতায় আছে, ‘গু’ মানে অন্ধকার। আর ‘রু’ শব্দের মানে তার নিরোধক জ্যোতি। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ‘গুরু’ বিষয়ক এক মূল্যবান প্রবন্ধ আছে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ঠাকুর বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরই একমাত্র গুরু। আমাদের গুরু হলেন আমাদের আচার্য। এই গুরু ব্রাহ্মণ না শূদ্র, হিন্দু না মুসলমান না খ্রিস্টান, সন্ন্যাসী না গৃহস্থ, এ সব প্রশ্নই আসতে পারে না। ব্রহ্মানন্দ আরও বলছেন, ‘যিনি ব্রহ্মবিৎ, তিনিই গুরু।’

আর রাম-রহিম এবং গোটা দেশের এহেন বহু গেরুয়াধারী গুরু মন্ত্র দেয়, আবার ব্যবসাও চালায়। ক্ষমতারও ঘনিষ্ঠ তারা। রাম-রহিম তো অপরাধী। অথচ সে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দলিত ভক্তের গুরু। আবার সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ভক্তের উন্মাদনাকে মূলধন করে নিজেই নিজেকে জনসমাজের একটা বড় অংশের কাছে ‘মিথ’ করে তুলতে সক্ষম। সে হল নানা ভাবে ভিড়ের সম্মতি নির্মাণ। যাকে বলে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’। নরেন্দ্র মোদী যখন ভোটের সময় এই গুরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে টুইট করেছিলেন তখনও কিন্তু তিনি ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত। মোদী সরকার নািক বিরোধী নেতাদের দুর্নীতিতে আপসহীন। সিবিআই আর এনফোর্সমেন্ট কত নেতার বেডরুমে ঢুকে পড়ছে। আর এই সব ভণ্ড-বুজরুক ধর্মগুরুদের ভোটব্যাংকের জন্য ব্যবহার করা প্রয়োজন বলে তিন বছর চোখ বুজে ছিল সরকার।

যত দিন যাচ্ছে ভারতে ‘রাষ্ট্র’ নামক শব্দটিকে আর ‘ভাল’ শব্দ বলে মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্র আমজনতার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। এক ভয়ংকর বিধ্বস্ত সময়ের মধ্যে বসবাস করছি আমরা। প্লেটোর সেই কল্পরাজ্য কোথায়? রাষ্ট্রের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা যত বাড়ছে, উগ্র জাতীয়তার গর্জন তত তীব্র হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকে, সকলের অলক্ষ্যে ‘জনমত’ নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফুঁড়ে বের হয়। সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। যে ভাবে সিমেন্টের প্রাচীর থেকেও দেখি সবুজ উদ্ভিদ জন্ম নেয়।

সুপ্রিম কোর্টের ব্যক্তিপরিসর সম্পর্কিত রায় গুমোট এই আবহে দখিনা বাতাসের মতো। গোটা দুনিয়া জুড়ে ব্যক্তিপরিসরের সংকট নিয়ে বিতর্ক চলছে। সান মাইক্রোসিস্টেমস-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার স্কট ম্যাকনেলি ১৯৯৯ সালে ঘোষণা করেন, ‘প্রাইভেসি ইজ ডেড’। শুধু তিনিই নন, বিশ্বের বহু কেষ্টবিষ্টুই ব্যক্তিপরিসরের ‘অবিচুয়ারি’ লিখতে শুরু করে দেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লন্ডন, এমনকী মার্কিন মুলুকেও ব্যক্তিপরিসর রক্ষার জন্য ডেটা সুরক্ষা আইন, নাগরিক এবং উপভোক্তার নানা অধিকার নিয়ে বহু সংস্থা সরব হয়ে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য।

বিজেপি ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, আদালতের রায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, নাগরিকের ব্যক্তিপরিসর সুরক্ষার জন্য। রাষ্ট্রের সঙ্গে এই রায় নিয়ে কোনও বিরোধ নেই। কারণ ব্যক্তিপরিসরের অধিকার আজও চরম নয়। তাই নিরাপত্তার জন্য আধারই হোক আর সন্ত্রাস দমন আইন, রাষ্ট্রের ভূমিকা লঘু হচ্ছে না।

এখানেই মজা। আসলে গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় সরকার সম্পর্কে এমন একটা ভাবনা সমাজে তৈরি হয়েছে যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এখন অতীত জমানার চেয়ে অনেক বেশি। মানুষের ভাল চায় বলেই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র পারলে নাগরিকরা কোন দিন কী রঙের জামা পরবে তা-ও ঠিক করে দেয়। ব্যক্তিপরিসর বিষয়ক আদালতের রায় দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রাসঙ্গিকতা যেন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধ্বজা উড়ছে তখনই কিন্তু উপযোগবাদী দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম ‘প্যান অপ্‌টিকন’ নামে এক কাঠামো নির্মাণের প্রস্তাব দেন। যেখানে এক জন নিরাপত্তাকর্মী থাকবেন, যিনি অট্টালিকাবাসী সকল ব্যক্তির উপর নজর রাখবেন। সে কথা বাসিন্দাদের বলে দেওয়াও হবে। তাতে নাকি বাসিন্দারা সচেতন ভাবে সুশৃঙ্খল নীতিসম্মত জীবনযাপন করবেন। আজ এত বছর পর ভারত নামক দেশটিকেও এক দিকে এক নয়া ‘প্যান অপ্‌টিকন’ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। আবার অন্য দিকে ধর্মীয় অন্ধত্ব, ভিড়ের উন্মাদনাকেও সুড়সুড়ি দিয়ে নির্বাচনী গণতন্ত্রের রথের রশি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অতএব? পঞ্চকুলায় তাণ্ডবনৃত্য হবে। প্রবীণ তোগাড়িয়া এবং সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে। আর আমরা লালকেল্লা থেকে মন কি বাত, এক নতুন ভারতের কল্পকাহিনি শুনতেই থাকব। শুনতেই থাকব। দীর্ঘমেয়াদি হবে এই দ্বিচারিতা। এ কি রাজনৈতিক দ্বৈতবাদ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন