আবার উষ্ণতার মাস, আবার গণজনতার দিগন্তবিস্তৃত ভাবাবেগ ও তাতে মুহুর্মুহু আঘাত এবং আবার ‘এক দিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে’র পিঠোপিঠিই এসে পড়ল মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার ক্ষণ। লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনেকে জিতে যাবে, কেউ কেউ হেরেও যাবে। জয়ীদের মধ্যে অল্প কিছু জন টিভি চ্যানেল আলো করে বলবে ‘আমি ভবিষ্যতে কার্ডিয়োলজিস্ট হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই’, হেরে যাওয়াদের মধ্যে অল্প কিছু জন আত্মহত্যা করবে। টিভিতে তাও দেখাবে হয়তো। আমরা তখন চ্যানেল পাল্টে বলব, নৌবিদ্রোহের কারণ, ফলাফল লিখেছিলাম চার পাতা জুড়ে, তাও জাস্ট দু’নম্বরের জন্য লেটার পাইনি জানো!
এবং আবার আমরা কিছু কথা বলব না, যেগুলো এক জন মাধ্যমিক উত্তীর্ণকে বলা দরকার। এবং কিছু কথা বলে যাব আগত সমস্ত প্রজন্ম জুড়ে, যে কথাগুলো হয় অকার্যকর অথবা মিথ্যায় পরিণত হয়েছে বহু দিন যাবৎ। যেমন, মাধ্যমিক একটি মেধা মূল্যায়নের পরীক্ষা, যেমন, মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি। এই ‘মিথ’গুলোর শুরু মাধ্যমিক দিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক, নিট, কলেজের সেমেস্টার, ফাইনাল, স্নাতকোত্তর, বিস্তীর্ণ পথ জুড়ে এই মিথ্যেরা ছড়িয়ে থাকবে। আমরা প্রতি বার জানব ‘এই পরীক্ষাই’ আমাদের মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন এবং এর ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ। পরীক্ষায় সফল হলে বাকিদের কাছে তো বটেই, নিজের কাছেও বেশ কেউকেটা হয়ে উঠব। খারাপ ফল করলে ভেঙে পড়ব। এ ভাবেই আমরা এক পরীক্ষা থেকে অন্য পরীক্ষায় গড়িয়ে যাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকব জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বছর। তার পর এক দিন জীবন নামের কেউ এক জন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আজকের পৃথিবীকে বুঝতে গেলে, বেঁচে থাকতে গেলে, তাতে ‘সফল’ হতে গেলে যে যে শিক্ষার দরকার তার প্রায় কিছুই আমরা স্কুল- কলেজে শিখিনি, আমাদের শেখানো হয়নি। কিন্তু আমরা যে হেতু সবাই বহু কাল হল স্বীকার করতে ভুলে গিয়েছি যে, আমরাও ভুল করতে পারি, ভুল ভাবতে পারি, তাই আমরা মরে যাব, তাও স্বীকার করব না যে আমরা একটা অকার্যকর প্রক্রিয়ার মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে, একটা অচল হয়ে যাওয়া ব্যবস্থার মধ্যে বেঁচেছি এতগুলো বছর, একে জড়িয়ে ধরে লতিয়ে উঠেছি একটা বিশাল পাঁচিলের ও পাশে পৌঁছনোর জন্য, যার ও দিকে রাখা আছে পৃথিবীর যাবতীয় সুখ এবং শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছি যে আমরা ‘পড়াশুনো ও জীবন’ নিয়ে, পাঁচিল ও সুখ নিয়ে যা জানি ও বুঝি তাতে বড়সড় গলদ রয়েছে।
প্রথাগত শিক্ষার যে সংকট-বেগ, তা দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর জটিল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল মাধ্যাকর্ষণকে ছাড়িয়ে বেরোনো যাবে না। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের থেকে শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্য হল, এর সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত ভাবে বেঁচে থাকা, এবং গুণগত ভাবে ভাল থাকা প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল। স্বীকার করা ভাল আমরা কেউ অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণতার বিকাশের জন্য স্কুল-কলেজে যাই না, দিনের পর দিন একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের কোন নির্দিষ্ট গুণটির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরে সযত্ন লালনপালন দরকার, তাও মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয় না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার এক কথায় উদ্দেশ্য, চাকরি। বিভিন্ন ধাপ এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সময় পেরিয়ে, একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পারদর্শিতা লাভ করে সেই ক্ষেত্রটিতে কিছু অবদান রাখা এবং তার বিনিময়ে উপার্জন। তবে অবশ্যম্ভাবী উদ্দেশ্য চাকরি হলেও এক জন ছাত্রীর গড়পড়তা কুড়ি বছরের ছাত্রী-জীবনে বিভিন্ন বিষয় থাকে যার মাধ্যমে ধাপে ধাপে তাকে জীবন ও পৃথিবী নিয়ে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা যায়। অর্থাৎ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভাল ফল করে শেষ পর্যন্ত ভাল চাকরি পাওয়াই এই শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের উদ্দেশ্য ধরে নিয়েও অন্তত আদর্শগত ক্ষেত্রে জীবন ও পৃথিবী সম্বন্ধে প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাটিকে পাশে রেখে দেওয়াই যায়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই দুই উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়েই আজ খুব বড় প্রশ্নের সম্মুখীন। আদর্শগত স্তরে তার প্রথম ও প্রধান কারণ, তথ্য আর জ্ঞানকে বহু কাল হল আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। তথ্য— আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান (এবং ক্ষমতাশালী) জিনিস। সোনা, তেল, বন্দুকের নল ইত্যাদি অনেককে পিছনে ফেলে সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে ওঠার এই দৌড় সে শুরু করেছিল শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে। ফলে শিল্পবিপ্লবের স্বার্থেই তৈরি হয়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যের আহরণ, সঞ্চয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে তার প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মেকলে সাহেবের হাত ধরে তৈরি হয়ে ওঠা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায়ও তার ছাপ পড়ে। কিন্তু হায়, শিল্পবিপ্লব থেকে মেকলে সবাই ইতিহাস হয়ে গেলেও আমরা আজও সেই তথ্য, ও তার সঞ্চয়নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার মাটিতে বেড়ে উঠছি তিন-চার (নাকি আরও কম?) বছর বয়স থেকে। আমরা বুঝতেই পারছি না, তথ্য আজ এক দিকে যেমন অত্যন্ত মূল্যবান, তেমন একই সঙ্গে তা অত্যন্ত সহজলভ্য। অন্তত স্কুল-কলেজে আমরা যে তথ্য মুখস্থ করি দিনের পর দিন, তারা তো বটেই। ফলে আজকের পৃথিবীতে আর তথ্যের সঞ্চয় এবং তার পুনরুৎপাদন কোনও মানেই রাখে না। মানে যদি কিছু রাখে তা হল তথ্যের বিশ্লেষণ, যাকে বৃহত্তর অর্থে জ্ঞান বলা যায়, অথচ উদ্বেগজনক ভাবে আমরা যার সুস্থ আদান-প্রদান ভুলে গিয়েছি।
এর ফলে অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আমরা এক জন ছাত্রীর মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে, তার আলোয় দেখা পৃথিবী নিয়ে এমন বিকৃত এক বোধের জন্ম দিচ্ছি, যার বাইরে হয় সে আর সারা জীবন বেরোতেই পারছে না, বা যখন বুঝতে পারছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় না আছে দৈনন্দিনের জলকাদা মাখা বাইরের পৃথিবীকে বুঝে ওঠার সংস্থান, না আছে আমাদের ভেতরের মানবিক বৃত্তিগুলোর বিকাশের সুযোগ। কেন একটা বিষয় পড়ব, বাস্তব জীবনে তার গুরুত্ব কতটা, পৃথিবী ও তার মানুষজন সম্বন্ধে সে আদৌ আমায় কোনও ভাবে শিক্ষিত ও সচেতন করে কি না, এ সব প্রশ্ন আমরা কেউ করি না। আদর্শগত স্তরে শিক্ষাব্যবস্থা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েও বহু কাল প্রশ্নহীন হয়ে টিকে থেকেছে। কিন্তু আজ সে তার ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও বড়সড় প্রশ্নের সামনে। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তিতে একটা চাকরি পাওয়া যাবে, আজ সে দিন বিগতপ্রায়। প্রতিটি দেশ থেকে প্রত্যেক দিন কিছু চাকরি হারিয়ে যাচ্ছে। তার কারণ যেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, তেমন তার একটা বড় কারণ যন্ত্র। আমরা যে সমস্ত পেশা দেখি, বুঝি, তার জন্য তৈরি করি নিজেদের, তার মধ্যে কতগুলো আজ থেকে তিরিশ বছর পরে বেঁচে থাকবে সেটাই আজ প্রশ্নের মুখে। অথচ তা নিয়ে আলোচনা, সচেতনতা, নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সে ভাবে গড়ে তোলা দূরে থাক, আমরা দিনের পর দিন একটা প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কাল নিয়ে বাৎসরিক শোভাযাত্রা করে যাচ্ছি সম্মিলিত ভাবে।
প্রথম বিশ্বের দেশগুলি কিন্তু এই সমস্যা চিহ্নিত করেছে, কী ভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে কাউকে সত্যিকারের শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বড় করে তোলা যায়, বিভিন্ন বিষয়কে কী ভাবে আরও পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কিত করে শেখানো যায়, কাজ চলছে তা নিয়েও। আমরা সে সব থেকে বহু দূরে। শিক্ষাব্যবস্থায় বড়সড় গলদ রয়ে যাচ্ছে, সেই স্বীকারোক্তি থেকেও বহু দূরে।
একটা কাজ এখনই করা দরকার। অন্তত এই সহজ সত্যি কথাটা বলা দরকার যে, মাধ্যমিক একটি খুবই সাধারণ পরীক্ষা যা দিয়ে মেধা, বুদ্ধিমত্তা, এবং ভবিষ্যতে সফল বা অসফল হওয়ার সম্ভাবনা, কিছুই মাপা যায় না। অচল হয়ে যাওয়া মিথ-গুলো বয়ে বেড়ানোর থেকে একটা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব বহন করা এখন অনেক বেশি প্রয়োজন।