যদি টিভি না চাইতেন, যদি...

একটি মেয়ের কথা বলি। নাম সাহলা নেছিল। সে মালয়ালি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ধর্মের উল্লেখ শুধু এই জন্য যে, তার নিকাহ্‌-তে সে প্রথামত দান ‘মেহের’ চাইতে পারত। সে চেয়েছিল শুধু ৫০টা বই।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share:

আমরা সবাই ব্যথিত, দুঃখিত। এক সপ্তাহও পেরোয়নি অর্পিতা-র মর্মান্তিক হত্যার। তার মধ্যেই আরও একটি ঘটনা। বধূটি নাবালিকা। দু’ক্ষেত্রেই মূল ঘটনার রূপরেখা মোটামুটি একই। সংবাদপত্রের কারণে সকলেরই জানা। তার মধ্যেই খবরে উঠে এসেছে নন্দিতা বিশ্বাসের মৃত্যু। মৃত্যুর মিছিলের কি কোনও শেষ নেই? পারিবারিক হিংসায় দিল্লির পরেই কলকাতা— উঠে এসেছে এমন লজ্জাজনক তথ্যও।

Advertisement

তার কিছু দিন আগেই ঘটে আর একটি বধূহত্যা। যদিও তা আপাত ভাবে আত্মহত্যা। সেই আশ্চর্য মেয়েটি, শ্রাবন্তী ঘোষ, গল্পের বই পড়ত। তার জন্য বিদ্রুপের শিকার হত মেয়েটি। আর একটু পড়তে চেয়েছিল। তাই তার বাপের বাড়ির লোকদের জবাবদিহি চেয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এই পারিবারিক সালিশি সভা চলাকালীন মেয়েটি আত্মহত্যা করে। সেই মেয়েটির বইয়ের তাকে রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, অমিতাভ ঘোষসবাই শুধু নীরবে তাকিয়ে দেখেছিলেন নারীত্বের, বিদ্যার, মনুষ্যত্বের অবমাননা।

যেমন নীরবে তাকিয়ে আছি আমরা। কথা বলছি সেই গতানুগতিক শব্দে। কেন পণপ্রথা খারাপ, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের নির্মমতা, তাদের উচিত শিক্ষা ইত্যাদি। কখনও মেয়েদের সহনশীলতার ক্রমাবনতির দিকেও তির ঘুরে যাচ্ছে। পড়াশুনো করতে না দেওয়ার মতো সামান্য কারণে একেবারে আত্মহত্যা?এ কেমন ব্যাপার! গল্পের বই পড়া না পড়াতেই বা কী এসে যায়!

Advertisement

আসুন, আমরা একটু কুয়োর বাইরে উঁকি মারি। যাতে বুঝতে পারি যে, আমাদের এই গতে বাঁধা চিন্তারা যথেষ্ট তো? সেই মেয়েটির আর একটু শিক্ষার, আর একটু বই পড়ার স্বাধীনতার জন্য আপ্রাণ (আক্ষরিক অর্থেই) চেষ্টাকে আপনার সৃষ্টিছাড়া মনে হলেও, সত্যিই কি তা-?

একটি মেয়ের কথা বলি। নাম সাহলা নেছিল। সে মালয়ালি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ধর্মের উল্লেখ শুধু এই জন্য যে, তার নিকাহ্‌-তে সে প্রথামত দানমেহেরচাইতে পারত। সে চেয়েছিল শুধু ৫০টা বই। যেমেহেরহিসেবে স্বাভাবিক ভাবে গয়না বা অর্থ চাওয়া হয়, সেখানে নানান দুষ্প্রাপ্য বই।

আর একটি মেয়ের কথা। শ্রুতি কৃষ্ণা। বিয়েতে সোনারুপোয় সাজতে চায়নি সে। গম ও ধানের তৈরি গয়নায় নিজেকে সাজিয়েছিল। কালিদাসের শকুন্তলা যেন। তবে সমাজ কাব্যিক ভাবে নেয়নি, বরং প্রচণ্ড সমালোচিত হয় সে। তবু অনড় থাকে।

যেমন অনড় থাকে বাংলাদেশের তসমিন জারা। তার নিকাহ্ বয়কট করে পরিচিত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরা। কারণ? কোনও গয়না না পরে, ঠাকুমার সাদা সুতির শাড়ি পরে নিকাহ্‌ করে সে।

এই সব ঘটনা উল্লেখের কারণ? কারণ কয়েকটি আপাতবিচ্ছিন্ন ঘটনার মাধ্যমে একটি দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ। পরিবর্তন প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার। নির্মম নির্যাতনের ঘটনাকে ছোট না করেই প্রশ্ন করা, আমাদের মেয়েদেরও কি দায় থেকে যায় না? আমরা কি জমজমাট বিয়েবাড়ি, লাল বেনারসি, গা-ভর্তি গয়নার প্রলোভন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি? যত বড় আধুনিকাই হই, শেষ পর্যন্ত উপোসটুপোস করে, পিঁড়িতে বসে, লাজুক মুখে হবু বরের চার পাশে ঘুরতে শুরু করি। আমাকে সম্প্রদান করা হয় এ হাত থেকে ও হাতে, তা-ও মেনে নিই। বলি না, আমি এক শিক্ষিত স্বাবলম্বী মহিলা, আমি নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করতে পারি। রাধারাণী দেবীরা শুধু গৌরবময় অতীতের অংশ হয়ে থেকে গেলেন?

আপনারা বলবেন, সব দোষ মেয়েদের। যারা পণ চাইছে, বিয়ের পর বিভিন্ন দাবিদাওয়া করছে, বই পর্যন্ত পড়তে দিচ্ছে না, তাদের দোষ নেই?

যদি আপনি দানে পঞ্চাশটি বই চাইতেন, তা হলে কি বই পড়া নিয়ে খোঁটা দেওয়ার আগে লোকে দুবার ভাবত না? আপনি তো গাঁইগুঁই করে মধ্যবিত্ত বাবার থেকে ৪২ ইঞ্চি টিভিটা বিয়েতে জোগাড় করেছেন, যাতে আপনারপ্রেস্টিজবাড়ে। এ বার শ্বশুরবাড়ি যখন হন্ডা সিটি গাড়ির দাবি পেশ করবে, শুধু তাদের দোষ থাকে কি? আপনি মায়ের গলা থেকে তাঁর বিয়ের হারটা চেয়ে নিয়েছেন এই অজুহাতে, দিদির বিয়েতে মা তো মোটা বালাটা দিয়েছিল। ওই হারটাই শাশুড়ি যখন চাইলেন ননদকে দেবেন বলে, আপনার সঙ্গে ঝগড়া অনেক দূর গড়াল। না-ই বা চাইতেন হারটা! কী হত যদি কম গয়না পরে বিয়ে করতে যেতেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় বিয়ের ছবি কিছু কম লাইক পেত?

কে বলেছে, আপনাকে এ সব কথা? হবু স্বামী, যাঁর সঙ্গে গত এক বছরডেটকরছেন? যদি বলে থাকেন, তা হলে দুবার ভাবুন। নাকি তাঁর মোটা মাইনের চাকরি আপনাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না? অথবা বিয়ে ভেস্তে যাওয়ার ভয়? কী হয় বিয়ে ভেস্তে গেলে? খেতে পাবেন না? বাবা-মা এত কষ্ট করে পড়িয়েছেন, কিছু চাকরি অন্তত জোগাড় করে নিতেই পারবেন।

নাকি আপনি অর্পিতা, নন্দিনীর মতো বলেওছিলেন বাবা-মাকে যে আপনি আর পারছেন না। কিন্তু উত্তরে এসেছিল, আরও কিছু দিন মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ। এমনকী শ্বশুরবাড়িতে যথাযথ খাওয়া পাওয়া যেত না বলে আপনিও মায়ের কাছে খেয়ে চাকরিতে যেতেন। তবুও আপনাকে মা বলেননি নিজের বাড়িতে ফিরে আসার কথা, আপনি স্বাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও। আপনারও সাহস হয়নি সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে। হয়তো আপনি অপেক্ষা করছিলেন মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সাহসের জন্য। মা হয়তো ভেবেছিলেন আপনার শিশুটি জন্মালে সব ঠিক হয়ে যাবে। যেমন মায়েরা ভাবেন, ভেবে এসেছেন। বিয়ে-ফেরত মেয়েদের প্রতি সমাজের চোখরাঙানি অবশ্যই একটা কারণ। আর বিয়ের খরচ, লাল বেনারসি, গা-ভর্তি গয়না, ৪২ ইঞ্চি টিভি-র খরচটাইনভেস্টমেন্টহয়ে যায়, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রিটার্নের কথাও মাথায় আসে। সুচিত্রা ভট্টাচার্য/ঋতুপর্ণ ঘোষেরদহন’-এর রমিতা তার বৈবাহিক জীবনে বিপর্যয়ের পরেও বলেবাবা এত খরচা করে বিয়ে দিয়েছেন...’

যদি এই খরচটা আপনি না হতে দিতেন, যদি...

যদি সাহলা নেছিলের মতো টিভি-র বদলে বই চাইতেন, যদি তসমিনের মতো ঠাকুমার পুরনো শাড়িটুকু পরে বিয়ে করতেন বা শ্রুতি কৃষ্ণার মতো ধানের গয়না পরতেন, তা হলেও আপনার সঙ্গে রূপালি, অর্পিতা, শ্রাবন্তী বা নন্দিনীর মতো ঘটনা ঘটতএমন হলফ করে বলা যায় না।

তবু আমরা তখন মাথা উঁচু করে আপনার পাশে দাঁড়াব। যুগসঞ্চিত প্রথা, অনিশ্চয়তার, লোভের দায়ভার আমাদের মাথা নিচু করে দিতে পারবে না। নারীর আপন ভাগ্য জয় করবার কথা তো সেই কবে থেকে চলছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন