বছরের শেষ সূর্য যদি প্রশ্ন করে, কেমন ছিলে, কী উত্তর মিলবে? বিশেষত সে প্রশ্ন যদি সাংবাদিক জগতের দিকে ধাবিত হয়? বাংলাদেশের দু’টি প্রধান দৈনিক সংবাদপত্র অফিস প্রথম আলো ও দ্য ডেলি স্টার-এর উপর উন্মত্ত জনতার আক্রমণ এখন বিশ্বময় অন্যতম দুঃসংবাদ। কী ভাবে সাংবাদিকরা সেখানে জ্বলন্ত অফিসে আটকে পড়েছিলেন, তাঁদের আটকে রেখে প্রাণসংশয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই তথ্য দুনিয়াময় প্রচারিত। অথচ পুরাকালে দূতকে যেমন অ-বধ্য বলে মনে করা হত, সংবাদ-দূতদেরও নৈতিক ভাবে অ-বধ্য হওয়ারই কথা। বিশেষত কর্মরত সাংবাদিককে প্রাণে মারা— নিকৃষ্ট জঙ্গি সন্ত্রাসীদের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু লক্ষণীয়, কেবল সন্ত্রাসী নয়, সাংবাদিকরা এখন নিয়মিত ভাবে সামাজিক উগ্রতা ও রাষ্ট্রিক অসহনশীলতার প্রিয় লক্ষ্য। অনেক ঝুঁকি নিয়ে যে সব সাংবাদিক সাক্ষাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, তাঁদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৫ সালের হিসাব, গোটা বছর জুড়ে অন্তত ৬৭ জন সাংবাদিক নিহত, যার অর্ধাংশেরও বেশি নিধনের দায় ইজ়রায়েলের। গাজ়ার অবর্ণনীয় সংঘর্ষে বোমাবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন সাংবাদিকরা। দক্ষিণ আমেরিকাতেও বহু সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, একাধিক দেশ মিলিয়ে। তা ছাড়া আছে সাংবাদিকদের বিচারের নামে, ভুল বিচারে, কিংবা বিচারহীন ভাবে বন্দি করে রাখার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এই বছর, ৪৭টি দেশে প্রায় ৫০০ সাংবাদিককে জেলবন্দি করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে। সব মিলিয়ে স্পষ্ট, এখন সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ শাণাতে উদ্যত ধর্মীয় জঙ্গিরা, কিংবা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র।
এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারত একাই প্রমাণ— গণতান্ত্রিক মতে নির্বাচিত সরকারও কী ভাবে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের বিনাশে উদ্যত। সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ তদন্তে বাধা দানে, কিংবা তাঁদের ভয় দেখানোয়, কিংবা সত্য বা তথ্য উদ্ঘাটনে তাঁদের তৎপরতা আটকাতে মিথ্যা অভিযোগ এনে বন্দি করায় এখন কেন্দ্রীয় সরকার, কিংবা বিভিন্ন রাজ্য সরকার অতীব পারদর্শী। গত কিছু বছর যাবৎ কাশ্মীরে সাংবাদিকরা কাজ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, প্রাণভয়ে ভীত। প্রসঙ্গত বাক্স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী, ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম।
সন্দেহ নেই, বাক্স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা যেমন জরুরি, পাশাপাশি এখন আরও একটি কাজ জরুরি— ভুল তথ্য, মিথ্যা প্রচার, ফেক নিউজ় প্রতিরোধ। কিছু ক্ষেত্রে এই কারণেও সংবাদজগৎ ক্রমশই সঙ্কটগ্রস্ত। এবং কিছু সাংবাদিক জেনেবুঝে মিথ্যা সংবাদের কারবার করেন বলে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্কট বাড়ে, তাঁদের উপরেও নেমে আসে সন্দেহ ও শাস্তির খাঁড়া। এই উত্তর-সত্য যুগে সাংবাদিকদের নিজ দায়িত্ব পালনে অতিশয় সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আবার তেমনই রাষ্ট্রের দিক থেকে জরুরি ও আবশ্যিক, সংবাদ ও সাংবাদিকের মর্যাদা পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা করা। আসল কথা, ভুল বা মিথ্যা বক্তব্য শেষ পর্যন্ত তত ক্ষতি করে না, কোনও সত্যসন্ধানী সাংবাদিকের ভুল শাস্তি যতখানি ক্ষতি করতে পারে। নতুন বছর আসার আগে আশা করা যাক, সমাজ ও রাষ্ট্র সাংবাদিকের দায়িত্বের যে গুরুত্ব বিস্মৃত হয়েছে, নাগরিক সমাজের নিরন্তর চিকিৎসাতেই সেই বিস্মরণের নিরাময় হবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে