Nitish Kumar

রাজনীতীশ

ডিগবাজি দক্ষতা ছাড়াও আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। এতগুলি শাসনপর্বের মধ্যে নীতীশ কুমার কিন্তু কোনও বারের সরকারই একার জোরে গড়েননি, একার জোরে লড়েননি। জোট ছাড়া তিনি এগোতে পারতেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৩
Share:

নীতীশ কুমার। —ফাইল চিত্র।

শিল্পের আকাঙ্ক্ষা থাকলেই শিল্পী হওয়া যায় না, শিল্পে উত্তীর্ণ যিনি, তিনিই শিল্পী। নীতীশ কুমারকে দেখে কথাটি নতুন অর্থে উপলব্ধি করা যায়। রাজনীতিকে যাঁরা বলেন সম্ভাবনার শিল্প, তাঁদের মানতেই হবে যে ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে সফলতম ‘শিল্পী’র দাবিদার হতেই পারেন নীতীশ কুমার, এবং দাবি করতেই পারেন রাজনীতি-শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ রাজনীতীশ উপাধি! বিহারে নবম বার মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন তিনি, কিন্তু তার চেয়েও বড় ‘কৃতিত্ব’, এর মধ্যে নিহিত রইল পাঁচ-পাঁচ বারের দলবদল, দিকবদল, ভোলবদলের বৃত্তান্ত। ব্যঙ্গবিদ্রুপ থেকে রঙ্গমশকরা ইত্যাদির পাশে মানতেই হয় তাঁর নিখুঁত সময়জ্ঞান, উল্লম্ফন-দক্ষতা। ডিগবাজিটি ঠিক কখন খেলে নিজেকে নিরাপদজালে নিক্ষেপ করে সিংহাসনটি দখল করা যায়, পাকা খেলোয়াড়ের মতো তিনি হিসাব কষতে পারেন। এ বারও একেবারে ‘ব্রাহ্মমুহূর্ত’-এ তিনি জানিয়ে দিলেন, চার বছর আগের ছেড়ে-আসা সঙ্গী এনডিএ-র সঙ্গে পুনর্মিলিত হচ্ছেন। খেলোয়াড়ের সময়জ্ঞান জরুরি প্রতিপক্ষকে হকচকিয়ে দিতেও। নীতীশের এই ডিগবাজিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে কত বড় ধাক্কা পড়ল, বিজেপির ভোটরাস্তা আরও কত মসৃণ হল, বিহারের নিজস্ব রাজনীতির গতিরেখাই বা কতখানি পাল্টাতে চলল, প্রশ্ন অনেক। কিন্তু সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে যা-ই বলুন না কেন, প্রশ্নগুলি যে এতটাই আকস্মিক ভাবে সামনে এসে পড়বে, দেশজোড়া রাজনীতি চর্চামহল তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

Advertisement

ডিগবাজি দক্ষতা ছাড়াও আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। এতগুলি শাসনপর্বের মধ্যে নীতীশ কুমার কিন্তু কোনও বারের সরকারই একার জোরে গড়েননি, একার জোরে লড়েননি। জোট ছাড়া তিনি এগোতে পারতেন না। বিজেপি এবং আরজেডি, দুই দিকে তাঁর দুই প্রধান জোটসঙ্গীকে ইচ্ছেমতো তিনি ধরেছেন ও সরিয়ে দিয়েছেন। দুই দিকের দুই দলই সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিতে তাঁর থেকে এগিয়ে থেকেও তাঁকে কৌশলে পরাস্ত করতে পারেননি। মানতেই হবে, বিহারে এই উদাহরণটি প্রতিষ্ঠা করে নীতীশ কুমার একটি বিরাট শিক্ষা দিয়েছেন ভারত-রাজনীতিকে। সেই বার্তা হল, জোট-রাজনীতির যুগে একদলীয় কৃতিত্বের মতোই গুরুত্বপূর্ণ— জোটসঙ্গী নির্বাচন। জোট-রাজনীতি তো শূন্যে উল্লম্ব থাকে না, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সামাজিক প্রকৌশল। সে দিক থেকেও নীতীশ কুমারের উদাহরণ বুঝিয়ে দেয়, জাত-রাজনীতির সম্ভাবনাসমূহও কত বহুধাবিস্তৃত। বাস্তবিক, এ বার বিজেপি নেতা সম্রাট চৌধরি আর বিজয়কুমার সিন্‌হাকে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখে অনুমান করা যায়, বিজেপি অতঃপর পূর্বাপেক্ষা দুর্জয়তর গতিতে বিহার রাজনীতির কেন্দ্রে ধাবিত হবে। কিন্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নীতীশ কুমারের মূল ভোটারগোষ্ঠী পশ্চাৎপদ জনজাতি তাতে বিরূপ বোধ করবেন, এমন না-ই হতে পারে। বিজেপি যে ওবিসি/ইবিসি মানসভুবনকে পাশে রেখে চলতে পারে, নীতীশ কুমারের সৌজন্যেও তা পূর্বপ্রমাণিত।

এই দিক থেকেই, ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ নীতীশ কুমারের কারণে কতখানি বিপন্ন হল, সেই আলাপে যাওয়ার আগে একেবারে গোড়ার প্রশ্নে ফিরতে হয়। যখন বিরোধী জোটটি তৈরি হয়েছিল, তখনই কি এই প্রশ্ন ওঠার কথা ছিল না যে বিরোধী নেতারা আসলে কতটা ‘বিরোধী’? নীতীশ কুমার একা নন, এই জোটে আরও অনেকেই ছিলেন, যাঁরা প্রয়োজনভিত্তিক রাজনীতিতে অতি দক্ষ, বস্তুত, সেটাই তাঁদের প্রধান পরিচয়। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সুকৌশলী সুনিপুণ রাজনীতি-অধিষ্ঠান এই বিচিত্র সুযোগসন্ধানী নেতাদের সমাহার দিয়ে নড়িয়ে দেওয়া ছিল কুহকসমান আশা— প্রায় অবাস্তব। একই সঙ্গে জোটরাজনীতি ও সত্তারাজনীতির এই বিকশিত রূপ আজ দেশজোড়া এক সুযোগসন্ধান সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সেই সংস্কৃতির ব্যাকরণটি অধিগত করায় বিজেপি আর সবার চেয়ে অনেক যোজন এগিয়ে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন