Firecrackers

শব্দের উৎসব

আমোদপ্রিয় উচ্ছৃঙ্খল বাঙালিও ইঙ্গিতটি বুঝে নিতে ভুল করেনি। তারা ডেসিবেলের সূক্ষ্ম হিসাব জানে না। শুধু এইটুকু বোঝে যে, শব্দমাত্রা বৃদ্ধি আসলে এত কালের গড়ে তোলা বাজি সংক্রান্ত সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করার সরকারি অনুমতিপত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

উৎসব কি সকলের নয়? এক বিশেষ তিথি, দিনক্ষণকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সৌহার্দ বিনিময়, দুর্বলের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো মানবিক গুণাবলি চর্চার সময় নয়? না কি তা শুধুমাত্র এক শ্রেণির মানুষের উৎকট উল্লাস প্রদর্শনের অজুহাতমাত্র? উৎসবের পবিত্র আবহে এমন অপ্রিয় প্রশ্ন ওঠা উচিত ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত দীপাবলি ও ছটপুজোর পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নগুলি তোলা জরুরি। বিশেষত, দীপাবলির দিনে-রাতে বাজির দাপটে প্রমাণিত যে, এই বছর বাজির পরীক্ষায় পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাজি সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশাবলি পালনে প্রশাসনিক ব্যর্থতা অবশ্য নতুন নয়। প্রতি বছরই আদালতের নির্দেশকে অমান্য করে এ রাজ্যে দেদার নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি হয়, বাজির শব্দমাত্রাও হামেশাই নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে যায়। কিন্তু এ বছরটি যে বিশেষ রকমের ব্যতিক্রম হতে চলেছে, তা অনুমান করা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কর্তৃক বাজির শব্দমাত্রা ৯০ ডেসিবেল থেকে বাড়িয়ে ১২৫ ডেসিবেল করে দেওয়ার ঘোষণায়। অনুমান যে অব্যর্থ, তা প্রমাণিত।

Advertisement

একে নিছক আনন্দ উদ্‌যাপন মনে করলে ভুল হবে। আসলে এ এক নিয়ম ভাঙার বার্তা। বার বার ক্ষতিকর প্রভাবের কথাটি স্মরণ করিয়ে বাজির ব্যবহারে লাগাম পরানোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমাজের এক বৃহৎ অংশ যে সমানে নিয়মকে অগ্রাহ্য করে চলেছে, তা কোনও প্রশাসনের কাছে স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। অথচ, এই রাজ্যে সরকার স্বয়ং নিয়ম ভাঙায় সস্নেহ প্রশ্রয় জুগিয়ে চলছে। তাই শব্দবাজির বাড়বাড়ন্তে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ ধরা পড়ে না প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের কণ্ঠে। বাজির সৌজন্যে শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও তাঁরা সচরাচর অবিচল থাকেন। উৎসবের অর্থ যে জনস্বাস্থ্যকে শিকেয় তোলা নয়, এই সহজ কথাটি এত দিনেও তাঁদের মগজস্থ হল না। বরং, বাজির শব্দমাত্রাকে ৯০ ডেসিবেলে বেঁধে রাখার রাজ্যের ‘নিজস্বতা’টুকুকেও বিসর্জন দিতে হল দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার অজুহাতে। যা নাগরিক জীবনের জন্য বিপজ্জনক বলে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত, সেই ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় রাখার এমন আত্মঘাতী তাগিদ কেন? না কি এর আড়ালে বাজি ব্যবসায়ীদের একাংশকে ‘খুশি’ রাখার রাজনৈতিক অঙ্কটি নীরবে সমাধা হল?

আমোদপ্রিয় উচ্ছৃঙ্খল বাঙালিও ইঙ্গিতটি বুঝে নিতে ভুল করেনি। তারা ডেসিবেলের সূক্ষ্ম হিসাব জানে না। শুধু এইটুকু বোঝে যে, শব্দমাত্রা বৃদ্ধি আসলে এত কালের গড়ে তোলা বাজি সংক্রান্ত সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করার সরকারি অনুমতিপত্র। তেমনটিই সুসম্পন্ন হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, হাসপাতালে, যেখানে কোনও ধরনের বাজি ফাটানোই নিষিদ্ধ, সেখানে যথেচ্ছ বাজি ফাটানোয় মেতেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। হাসপাতাল-সংলগ্ন অঞ্চল, যা ‘সাইলেন্স জ়োন’ বলে চিহ্নিত, সেখানেও মুহুর্মুহু ফেটেছে শব্দবাজি। পুলিশের ভূমিকাটিও উল্লেখযোগ্য। কোথাও তারা নীরব দর্শক হয়ে থেকেছে, কোথাও তাদের নাস্তানাবুদ করেই বাজি-উৎসবে মেতেছেন নগরবাসী। উৎসব-শেষে অবশ্য কড়া পদক্ষেপের নিয়মমাফিক বিবৃতি মিলেছে। কিন্তু ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন, এ-হেন আশ্বাস বাস্তবায়নের সম্ভাবনা প্রায় নেই। সুতরাং, এই সার্কাস চলছে, চলবেও।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন