Indian Economy

বৃদ্ধির প্রশ্ন

ত্রৈমাসিকে অর্থব্যবস্থায় মোট মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বেড়েছে ৬.৫%, অর্থাৎ জিডিপির বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তার ব্যবধান ১.৯ শতাংশ-বিন্দু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এই অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হারের আনুমানিক অঙ্কটি সবাইকে একেবারে চমকে দিয়েছে। দেশি-বিদেশি ক্রেডিট রেটিং সংস্থা থেকে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক পারঙ্গমতা বিষয়ে সন্দিহান অর্থশাস্ত্রীকুল তো বটেই, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্ক, এমনকি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের কোনও পূর্বাভাসও এই অঙ্কটির ধারেকাছে ছিল না। সবার চোখের আড়ালে অর্থব্যবস্থা এমন স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠল কী ভাবে, স্বভাবতই তা নিয়ে কিছু সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সে আলোচনায় ঢোকার আগে বলা প্রয়োজন, গোটা দুনিয়া যখন আর্থিক মন্দার আশঙ্কায় কম্পমান, ব্রিটেন থেকে জাপান, চিন থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন আর্থিক বৃদ্ধি অতি শ্লথ, তখন ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যদি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সত্যিই ৮.৪% হারে বেড়ে থাকে, তা অতি গৌরবের বিষয়। কিন্তু, উৎসবের মরসুমেও যখন যথেষ্ট ভোগব্যয় বাড়েনি, কর্পোরেট সংস্থাগুলি লাভের পরিমাণ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কৃষি-উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তা বর্তমান, আন্তর্জাতিক বাজার শ্লথ বলে রফতানির পরিমাণও নিম্নমুখী— এর ফাঁকে জাতীয় আয় এমন চমকপ্রদ হারে বাড়ল কী ভাবে?

Advertisement

এই ধাঁধার উত্তর পাওয়ার জন্য তৃতীয় ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাগ করে দেখা প্রয়োজন। জিডিপির মোট অঙ্কে ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের ভাগ গত বছরের ৬১.৩% থেকে কমে হয়েছে ৫৮.৪%। সরকারি ভোগব্যয়ের পরিমাণও কমেছে, ৮.৭% থেকে ৭.৮%। কমেছে নেট রফতানির পরিমাণও। অন্য দিকে, বেড়েছে মোট মূলধন নির্মাণের পরিমাণ, অর্থাৎ লগ্নি; এবং জিডিপি হিসাবে ‘ডিসক্রেপেন্সি’ বা গরমিলের পরিমাণ। অন্য পরিসংখ্যান বলছে, এই একই সময়কালে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় কর আদায়ের হার বেড়েছে। ভোগব্যয়ের পরিমাণ যদি কমে, তবে সেই বাড়তি কর আদায়ের সিংহভাগ এসেছে আয়কর থেকে। প্রত্যক্ষ করদাতাদের বেশির ভাগই যে-হেতু সংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত, ফলে এই পরিসংখ্যান বলছে যে, সংগঠিত ক্ষেত্রে আয় বেড়েছে তাৎপর্যপূর্ণ হারে। বিভিন্ন সূচক থেকে ভারতে ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের যে ছবি পাওয়া যায়, এই অনুমানটি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ— আয় পুঞ্জীভূত হচ্ছে কতিপয় মানুষের হাতে। তাঁদের মোট আয়ের অনুপাতে ভোগব্যয়ের পরিমাণ যে-হেতু তুলনায় কম, ফলে জিডিপির অনুপাতে মোট ভোগব্যয় সঙ্কুচিত হচ্ছে। অন্য দিকে, সরকারও খরচের অভিমুখটি ক্রমে ঘোরাচ্ছে পুঁজি-নিবিড় ক্ষেত্রে মূলধন নির্মাণের দিকে। তারও প্রত্যক্ষ লাভ পৌঁছবে মুষ্টিমেয় লগ্নিকারীর হাতে। অর্থাৎ, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যানকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের সূচক মনে হচ্ছে, তা আসলে একটি গভীরতর অসুখের উপসর্গমাত্র।

তার পরও প্রশ্ন থাকে। এই ত্রৈমাসিকে অর্থব্যবস্থায় মোট মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বেড়েছে ৬.৫%, অর্থাৎ জিডিপির বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তার ব্যবধান ১.৯ শতাংশ-বিন্দু। অর্থাৎ, জিডিপির আনুমানিক সংখ্যাটি সম্ভবত বাস্তবের চেয়ে বেশি। কেন তা বেশি হওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্নের উত্তর এই অনুমানের পদ্ধতিতে রয়েছে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যদিও মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্র-নির্ভর, জিডিপির অনুমান করা হয় সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। ফলে, ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য অসংগঠিত ক্ষেত্রকে কোণঠাসা করলেও তার প্রভাব এই পূর্বানুমানে পড়ে না। অন্য দিকে, পূর্ববর্তী বছরের পরিসংখ্যান থেকেও বিভিন্ন গুরুত্বসম্পন্ন গুণিতক ব্যবহার করে এই অর্থবর্ষের সম্ভাব্য জিডিপির অঙ্কটি কষা হয়। পূর্ববর্তী বছরে যদি কোনও আর্থিক ধাক্কা থেকে থাকে, তবে তার প্রভাব সেই গুণিতকের পথ বেয়ে বর্তমান বছরের পূর্বাভাসেও পড়ে। গত দু’টি অর্থবর্ষের মধ্যেই অতিমারি ও লকডাউনের বিভীষিকা ছিল, ফলে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আনুমানিক বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। কিন্তু, প্রকৃত সংখ্যা হাতে আসার আগেই নির্বাচন পেরিয়ে যাবে। অর্থনীতিকে হারিয়ে রাজনীতি জিতে যাবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন